শ্রীশ্রীরামঠাকুরের সিদ্ধাশ্রম পরিব্রাজন
( দীক্ষা গ্রহণের পর )
ঠাকুরের অত্যাশ্চর্য্য, অলৌকিক অভিজ্ঞতা
Source: https://www.facebook.com/ramthakur.chowdhury.p.k.roy
ঠাকুরের অধ্যত্মজীবনের মহাশিল্পী,তাঁহার ঐ সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বশক্তিমান গুরুদেবের প্রকৃত পরিচয় আজো উদ্ঘাটিত হয় নাই। তিনি নিজে কখনো তাঁহাকে প্রকাশ করিতে চাহেন নাই, শিবকল্প গুরুর প্রকৃত পরিচয়টি গোপন রাখিয়া নানা সময়ে তাঁহার উল্লেখ করিয়াছেন অনঙ্গদেব নামে। অনঙ্গদেব, অর্থাৎ অঙ্গ নাই যাঁহার-বিদেহী সত্তারূপে সর্ব্বভূতে বিরাজিত। গুরুর এই সার্ব্বজনীন ও নৈর্ব্ব্যক্তিক পরিচয়টিকে এই নামকরণের মধ্য দিয়া ঠাকুর প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিলেন। 'ভগবানের স্বরূপশক্তি' বলিয়াও কখনো কখনো স্বীয় গুরুর কথা শ্রদ্ধাভরে তিনি উল্লেখ করেছেন।
যাই হউক দীক্ষার পর ঠাকুরের গুরু, ঠাকুর ও তাঁর দু’জন গুরু-ভ্রাতা একত্রে হিমালয় ভ্রমণ করছিলেন। কত নদ নদী, বন পাহাড়, উপত্যকা তাঁহারা অতিক্রম করিলেন, তারপর উপস্থিত হইলেন হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের এক দুরধিগম্য সিদ্ধ-পীঠে। স্থানটির নাম যোগেশ্বর আশ্রম । হিম-বন্তের তুষার রাজ্য সেখানে শুরু হয় নাই। লতাবিটপীপূর্ণ একটি অনুচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে এই আশ্রমটি অবস্থিত। কোন মন্দিরাদি এখানে নাই । চারিটি প্রস্তর স্তম্ভের মধ্যস্থলে উন্মুক্ত প্রান্তরে অবস্থিত রহিয়াছে স্ফটিক নির্ম্মিত তুষার-শুভ্র একটী বিশাল শিবলিঙ্গ। এক অপার্থিব অপরূপ জ্যোতি এই স্ফটিকলিঙ্গের চতুর্দিক হইতে অবিরাম বিচ্ছুরিত হইতেছে। এই অলৌকিক দৃশ্য দেখিয়া রঠাকুর ও তাঁর অপর গুরুভ্রাতাদের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এই যোগেশ্বর শিবলিঙ্গের আরাধিকা এক শক্তিশালিনী সাধিকা। এ সময়ে সকলে তাঁহাকে দর্শন করিলেন । জটাজুটমণ্ডিতা, অপরূপ রূপলাবণ্যবতী এই তাপসী নারী দিনের পর দিন ধ্যানস্থা হইয়া এই জ্যোতির্ন্ময় শিবলিঙ্গের সম্মুখে উপবিষ্ট রহিয়াছে। ঠাকুর ও তাঁহার সতীর্থগণ এই ধ্যানমগ্না সাধিকার নাম দিয়াছিলেন “গৌরী মা"। এই পীঠস্থলীর দিব্য পরিবেশে তাঁহারা পাঁচ দিন অবস্থান করেন। ঠাকুর অনেক সময় এই স্থানটির প্রসঙ্গে বলতেন "যোগেশ্বরের মত এমন শান্তি এমন পবিত্রতা সারা হিমালয়েও ছিল দুর্লভ।"
গুরু ঠাকুর এবং তাঁরা গুরুভ্রাতা হিমালয়ে চলিতে চলিতে একটি অত্যাশ্চর্য্য, অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা উত্তরকালে ঠাকুর তাঁহার শিষ্যদের কাছে বলিয়াছিলেন। পার্বত্য অঞ্চলের এক গহন অরণ্যে তাঁহারা উপস্থিত হইয়াছেন। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ, জনমানবের চিহ্ন কোথাও নাই। সম্মুখেই রহিয়াছে এক প্রাচীন সাধন-গুহা। এই গুহার সম্মুখে ধুনী জ্বালাইয়া এক অতিবৃদ্ধ, বিশালাকায় মহাপুরুষ সমাসীন। গুরুদেব রামকে আড়ালে ডাকিয়া কহিলেন, “এই মহাত্মা হচ্ছেন এক দেবকল্প মহাসাধক। এঁ'র দেহটি অতি প্রাচীন। বহু শত বৎসর ধরে এখানে বসে তিনি সাধনা করছেন। এবার তাঁর সঙ্কল্প হয়েছে, কায়া পরিবর্তন করার জন্য। বহু পুণ্যবলে আজ তোমরা স্বচক্ষে এ অলৌকিক অনুষ্ঠান দেখবার সুযোগ পেয়েছ। মহাত্মার ধুনী থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, নীরবে তোমরা এই অপরূপ দৃশ্য দেখে নাও।” যোগাসনে উপবিষ্ট নিমীলিতনেত্রে মহাপুরুষের মুখে শুনা যাইতেছে অস্ফুট মন্ত্রের গুঞ্জরন। ধুনীর অগ্নিতে মাঝে মাঝে প্রদত্ত হইতেছে আহুতি, আর থাকিয়া থাকিয়া অগ্নিশিখা ধ্বক্ ধ্বক্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা হইতে হঠাৎ সেখানে আবির্ভূত হইল এক অতিকায় নাগরাজ। যন্ত্রচালিতবৎ মহা সর্পটি ধুনীর অগ্নি কয়েকবার প্রদক্ষিণ করিল। তারপর মহাপুরুষের সম্মুখে আগাইয়া আসিয়া হইল নিশ্চল, নতশির । রাম ও তাঁহার সঙ্গীরা সবিষ্ময়ে দেখিলেন, মহাপুরুষ এ সর্পটিকে ধরিয়া কুণ্ডলী পাকাইতেছেন। ক্ষণপরেই এটিকে তিনি ঐ প্রজ্জ্বলিত ধুনীর আগুনে নিক্ষেপ করিলেন। নাগরাজের দাহকার্য্য চলিতেছে, এমন সময় কয়েকবার কমণ্ডলুর মন্ত্রপূত বারি ছিটাইয়া দিয়া মহাপুরুষ অগ্নি নির্বাপিত করিলেন। সর্প-দেহটি তখনো পুড়িয়া একেবারে নিঃশেষ হয় নাই। চিমটা দিয়া টানিয়া আনার পর পাওয়া গেল একতাল অর্ধদগ্ধ গলিত মাংস-স্তূপ। মহাপুরুষ এটি হইতে কয়েকটি পিণ্ড প্রস্তুত করিলেন। এবার শুরু হইল তাঁহার অভিনব হোমক্রিয়া। ধুনীর আগুন তেমনিভাবে প্রজ্জ্বলিত রহিয়াছে । আর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মহাপুরুষ একটি করিয়া সর্প-দেহের পিণ্ড উহাতে আহুতি দিতেছেন। সর্বশেষ পিণ্ডটি কিন্তু অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইল না। আসনে বসিয়া নির্বিকার চিত্তে তিনি উহা গলাধঃকরণ করিলেন ।
নবীন সাধক রাম ও তাঁহার সতীর্থগণ বিস্ময় বিস্ফোরিত নয়নে এই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে চাহিয়া আছেন। কিন্তু ইহার পরে অলৌকিক দৃশ্যটি তাঁহাদের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইল সমগ্র জীবনে তাঁহারা সেটি আর ভুলিতে পারেন নাই।
সর্পের ঐ দেহ-পিণ্ডটি ভক্ষণের পরই বৃদ্ধ তাপস নিজ আসনের উপর দেহখানি এলাইয়া দিলেন। স্পন্দনহীন, নীরব নিশ্চল দেহটি দেখিয়া মনে হয় না যে, উহাতে প্রাণের চিহ্নমাত্র রহিয়াছে । খানিক পরে দেখা গেল, মহাপুরুষের দেহটি ক্রমে ক্রমে স্ফীত হইয়া উঠিতেছে। এই স্ফীতি আরে বৃদ্ধি পাইলে উহা হঠাৎ সশব্দে বিদীর্ণ হইয়া গেল, অভ্যন্তর হইতে বাহির হইয়া আসিল এক অনিন্দ্য সুন্দর, তরুণ তাপসমূর্ত্তি। এ যেন এক দিব্য ইন্দ্রজাল! বিগত প্রাণ, প্রাচীন মহাপুরুষের দেহটি তখন এক পাশে নিঃসাড় অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। নবসৃষ্ট তরুণ সাধক এটিকে তুলিয়া নিয়া অবলীলায় ধুনীর অগ্নিতে নিক্ষেপ করিলেন । তারপর দেখা গেল, বৃদ্ধ প্রাচীন তাপসের পরিত্যক্ত আসন, চিমটা ও কমণ্ডলু নিয়া ধীরে ধীরে তিনি অরণ্যের গভীরে কোথায় যেন অন্তর্হিত হইয়া গেলেন। রাম ও তাঁহার সতীর্থ এই অকল্পনীয় দৃশ্যের দিকে নির্নিমেষে চাহিয়া আছেন। বিষ্ময়ে কাহারো বাক্য বাহির হইতেছে না। হঠাৎ গুরুদেবের আহ্বানে তাঁহারা চমকিয়া উঠিলেন, বাস্তব জীবনের বোধ আবার ফিরিয়া আসিল।
প্রসন্ন-মধুর কণ্ঠে গুরুদেব রামকে কহিলেন, “বৎস, কায়া পরিবর্তনের যে অলৌকিক পন্থা। তোমরা আজ দেখলে, তা মহা-সমর্থ সাধকদেরই আয়ত্তাধীন। তোমরা তন্ত্র ও যোগরাজ্যের দুরূহ সাধনায় ব্রতী হয়েছ। এখানে এসে এ রাজ্যের মাহাত্ম্য প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা আজ জানতে পারলে। এটাই হল বড় লাভ।”
হিমালয় পরিব্রাজনের পথে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না এ সময়ে রামঠাকুর লাভ করিয়াছেন। সেবার তিনি ও তাঁহার এক গুরুভাই গুরুদেবের পিছনে পিছনে উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল দিয়া চলিয়াছেন। হঠাৎ পথে শুরু হইল প্রচণ্ড তুষার ঝটিকা ব্যাঘ্রগর্জ্জনের সঙ্গে এক একবার বিদ্যুৎ-রেখা ঝলকিয়া যায়, আর তুষারমণ্ডিত সারা গিরি-শিখর আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে। তারপর আবার সব কিছু অবলুপ্ত হয় সূচীভেদ্য অন্ধকারে। একলা পথ চলিবার আর উপায় থাকে না।
এদিকে কিন্তু হাড়-কাঁপুনে শীতে রামঠাকুর ও তাঁহার গুরু-ভ্রাতাদের দেহ একেবারে নিঃসাড় হইয়া পড়িয়াছে। কোন মতেই তাঁহারা আগাইতে পারিতেছেন না। এই সঙ্কট সময়ে প্রকটিত হইল গুরুদেবের এক বিষ্ময়কর যোগ বিভূতি। রাম এবং অপর শিষ্যটিকে দুই হাতে ধরিয়া তিনি তাঁহার নিজের দিকে আকর্ষণ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, অলৌকিক শক্তিবলে তাঁহার দেহটি এক বিশালকায় মূর্ত্তিতে পরিণত হইয়াছে। তরুণ শিষ্যদ্ধয়কে অবলীলায় কুক্ষির ভিতরে প্রবিষ্ট করাইয়া তিনি এই তুষার ঝটিকার মধ্য দিয়া স্বচ্ছন্দে আগাইয়া চলিলেন। উত্তরকালে ঠাকুর বলিয়াছেন, “এ তুষার ঝড়ের দাপাদাপি কয়েক দিন ধরিয়া চলিতে থাকে এবং এ কয়দিন তাঁহারা গুরুদেবের নবসৃষ্ট বিশাল কলেবরের আশ্রয়ে থাকিয়াই আত্মরক্ষা করেন।"