top of page

সাধু তারাচরণের বাল্য ও কৈশোর (পর্ব-১)

-----------------------------------

মা ডাকলেন, “তারা, তারা?”

কিন্তু তারার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বাড়ীর সকলের দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে, মা ভাত নিয়ে বসে আছেন। সেই সকাল থেকে তারার দেখা নেই। গুজরা গ্রামের দত্তবাড়ী। বাড়ীর বড় ছেলে তারাচরণ, সকলের নয়নের মণি। সকলে খোঁজে বেরোল, সকল সম্ভাব্য স্থানে চলল অন্বেষণ, কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। পিতা রসিকচন্দ্র উদাসী প্রকৃতির লোক, তিনি তেমন ব্যস্ত হলেন না, কিন্তু জননী অমলা ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কান্নাকাটি শুরু করলেন। কী জানি কোথায় গেল, কী হল, যেরকম আনমনা ছেলে! পথ চলতে চলতে কাগজের টুকরো পেলে, এমন কি গাছের পাতা পেলেও হাতে তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে নমস্কার করে আর বিড় বিড় করে কী বলে। আটবছরের ছেলের এ অভাস দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা চিন্তিত হন, সমবয়স্করা বিদ্রুপ করে। আহারে অন্যমনস্ক, পরিধানের বস্ত্রের প্রতি মায়া নেই, জলে কাদায় মাখামাখি হলে গায়ে শুকোয়। দলের ছেলেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আনমনা হয়ে যায়, নির্জ্জনে পুকুরপাড়ে শ্মশানের ধারে গিয়ে বসে পড়ে। সাথীরা হাজার ডাকাডাকি, টানাটানিতেও তাকে খেলায় ফিরিয়ে নিতে না পেরে আড়ি করে চলে যায়।

খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ একজন চীৎকার করে উঠল, “ঐ যে, ঐ যে- ঐ জঙ্গলের মধ্যে”- বাড়ীর উঠানের একটু দূরেই সীমগাছের জঙ্গল, তার চারপাশে বুনোগাছের ছায়া। কেউ ভারতে পারেনি, ঘরের এত কাছে তারাচরণ রয়েছে। সকলে ছুটে গেল, অবাক হয়ে দেখল তারাচরণ গভীর ধ্যানমগ্ন,দুটো আয়ত চক্ষু মুদ্রিত, তাকে খোঁজার জন্য এত হৈ চৈ তার কানে ঢোকেনি, তার ধ্যান ভঙ্গ করতে পারেনি।

মা অমলা ছুটে এলেন। ধাক্কা দিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, “এখানে এ জঙ্গলে সাপ বিছের মধ্যে কী করিস্? খাবিনা? শিগ্গীর উঠে আয়!” তারাচরণ যেন জেগে উঠল। তারপর নিজের চারদিকে এত মানুষের ভিড় দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মা?”

মা হাত ধারে টেনে বললেন, “ভাত খাবি না? উঠে আয়।” মা বুঝলেন ক্ষুধাতৃষ্ণাও ভুলে গেছে ছেলে। এ ছেলেকে নিয়ে কী হবে? এমন করে ডেকে কে খাওয়াবে মা মরলে? মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে গেল, মা জিজ্ঞেস করলেন, “কি করছিলি ওখানে?” তারা উত্তর দিল, "ধ্যান করছিলাম"

 

তারাচরণের পাঠশালায় গমন

-------------------------

ছেলের মতিগতি দেখে মা বাপ বিপন্ন বোধ করলেন: গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হল ছেলেকে। সঙ্গী সাথীরা পণ্ডিতমশায়ের নির্দেশ অনুযায়ী সরবে পাঠ আবৃত্তি করে, মুখস্থ করে। কিন্তু তারাচরণ নিজের খেয়াল খুশিমত পড়ে। একবার পড়লে তার পাঠ কণ্ঠস্থ হয়ে যায়, তারপর এক অক্ষরের আবৃত্তি করতে করতে সে নিঝুম হয়ে যায়, তার যেন কোন বাহ্যজ্ঞানই থাকে না। কোন কোন সময় পাঠ শেষ করে সহপাঠীদের খোঁচাতে সুরু করে,কারো বই টেনে নিয়ে লুকিয়ে ফেলে, কারো বা শ্লেটের লেখা মুছে দেয়, কারো কালির দোয়াত খাতার উপর ঢেলে দেয়। মহা হৈ চৈ সুরু হয়। ছাত্রদের চীৎকারে পণ্ডিতমশায়ের তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলে বেত নিয়ে উঠে আসেন, ছাত্রদের সমবেত নালিশের ফলে তারাচরণের কৈফিয়ত তলব করেন। শাস্তি প্রদান করতে গেলে তারাচরণ স্কুলের বেড়া ডিঙ্গিয়ে পালায়।

দুই পুকুরের মাঝখানে আমগাছে দোলনা ঝোলানো আছে। তারাচরণ দোলায় চড়ে দোল খায়। তার মন তখন অসীম আকাশের বিস্তারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ কী খেয়াল হয়, আমগাছের শাখায় প্রশাখায় উঠে যায়, তারপর একসময় ঝুপ্ করে পুকুরের শান্ত শীতল জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে; ডুব সাঁতার দিয়ে এপার থেকে ওপার করে।

ধীরে ধীরে অপরাহ্নের ছায়া এসে পড়ে। পাড়ার সঙ্গী সাথীরা এসে জোটে খেলার মাঠে, আসে হাডুডু খেলার আমন্ত্রণ। ঐ ভিজে কাপড়ে উঠে এসে তারাচরণ হাডুডু খেলায় জমে যায়। তার সঙ্গে দৈহিক শক্তিতে কেউ পেরে ওঠে না, বিপরীত দলকে হারিয়ে দিয়ে সে জয়লাভ করে,- তার একরোখা ভাবের জন্যও অনেকসময় সে জয়ী হয়। তারাচরণ যা একবার করবে ভাবে, প্রাণ গেলেও তা করে- করার চেষ্টা করে। মুখ থেকে কথা একবার বেরোলেই হল, মুখের কথা প্রতিপালনের জন্য প্রাণ যাক, তবুও তার সাধন করা চাই।

 

সঙ্গী সাথীদের সাথে তারাচরণ

--------------------------

তারাচরণ পাঠ্যপুস্তকে পড়ে-

নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল। তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল।- সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।

কবিতার শেষ লাইনে এসে তারাচরণ স্তব্ধ হয়ে যায়। সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরের মঙ্গল সাধনের জন্য, নিজের জন্য নয়। বৃক্ষ রৌদ্রতাপিত জনকে ছায়া দান করে, নিজের সুমিষ্ট ফল পরের জন্যই দান করে। নদী নিজের সুশীতল জল পরের জন্য বহন করে অর্থাৎ পরের মঙ্গলের জন্য-সেবার জন্য বেঁচে থাকা এবং সাধুরা তাই করে।

বুদ্ধদেব রাজার ছেলে। সর্বস্ব ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হলেন শুধু ‘পরহিত তরে’। এত বড় ত্যাগী হয়না, স্ত্রী এবং নবজাত পুত্রের মায়াবন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে তাদের নিমেষে ত্যাগ করে গেলেন।

চট্টলী ভাষায় বুদ্ধমন্দিরকে ‘কেয়াং’ বলে, বুদ্ধকে বলে ‘ফয়া’। গ্রামের বুদ্ধ মন্দিরে গিয়ে তারাচরণ বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তির সম্মুখে বারবার মাথা ঠোকে, বারবার প্রার্থনা জানায়, “হে ফয়া, তোমার মত যেন ধানে বসতে পারি। তোমার মত যেন সব ত্যাগ করতে পারি।” বুদ্ধের ত্যাগ দীপ্ত জীবন বালককে অনুপ্রেরণা জোগায়। বুদ্ধের ভাবনায় সে বুঁদ হয়ে বসে থাকে। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যানে বসে কাটিয়ে দেয়

ক্রীড়ামোদে বালকের মন তেমন সাড়া দেয় না। তার এই অস্বাভাবিক ধ্যানের ভাব সঙ্গী সাথীদের কৌতুকের ও পরিহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তবুও সঙ্গী বালকেরা সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত্র থাকত, কারণ কোনরকম উপহাস কিংবা মিথ্যা কথা বললে তারাচরণ তা’ ক্ষমা করত না। বিশেষতঃ মিথ্যাবাদীকে শাস্তি দিয়ে তার সঙ্গ পরিহার করত। দৈহিক এবং মানসিক শক্তিতে বালকেরা কেউ তার সঙ্গে পেরে উঠত না, তার ইচ্ছায় সে সঙ্গীদের চালিত করত, যে চলত না, তাকে দল থেকে বার করে দিত। এভাবে বালকদলের সে নেতা হয়ে দাঁড়াল।

 

কেউ দম্ভ প্রকাশ করলে তারাচরণের তার দর্প চূর্ণ করে ছাড়ত

----------------------------------------------

কৈশোর থেকে তারাচরণ মুখে যা বলত তা’ করার আপ্রাণ চেষ্টা করত। আপনার সমস্ত শক্তি ও মনপ্রাণ সেই বলা-কথার পরিপূরণের জন্য নিয়োগ করত। তারাচরণ নিজে কখনও কোন কাজ করে দম্ভ প্রকাশ করত না, কিন্তু কেউ দম্ভ প্রকাশ করলে তার দর্প চূর্ণ করে ছাড়ত।

তারাচরণ তখন বিশের কোঠায় পা দিয়েছে। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহ, দেহের অনুপাতে অসাধারণ শারীরিক শক্তি। তার চেয়ে মনের শক্তি অনমনীয়,দৃঢ়। একদিন অপরাহ্নে তারাচরণ দলের বালকদের নিয়ে খেলছিল। একদল কুস্তিগীর কোথায় কুস্তিতে জিতে বাড়ী ফিরছিল- তাদের মুখে অশ্লীল গর্ব্বোচ্ছল ভাষা,-কথায় কথায় দম্ভ ফুটে বেরোচ্ছিল। পরাজিতদের, লাঞ্ছিতদের জন্য তারাচরণের কোমল মনে কেমন আঘাত লাগল, আর বিজয়ীদের দম্ভ তাঁর কাছে অসহ্য মনে হতে লাগল। সে কুস্তিগীরদের সংগ্রামে আহ্বান করে বসল।

কুস্তিগীরদের তাগড়াই তাগড়াই, ভীমদর্শন চেহারা। তাচ্ছিল্য ভরে চোখের কোণে তারাচরণের দিকে তাকিয়ে তারা হেসে উঠল। কিন্তু তারাচরণ গর্জ্জে উঠল, “খবরদার, বাপের বেটা হও ত, এগিয়ে এস।” কুস্তিগীরেরা থমকে দাঁড়াল, তাদেরও অভিমানে লাগল। একটি নাবালকের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে ইতস্ততঃ করতে লাগল। তাদের মধ্যে বয়স্ক লোকটি বলল, “বাপ, কুস্তি শিখছ? গর্দ্দান যে ভেঙ্গে যাবে-।”

কিন্তু তারাচরণের একরোখা ভাব, গোঁ ধরলে ছাড়ানো মুস্কিল। সঙ্গী সাথীরা বারবার নিষেধ করতে লাগল, কিন্তু তারাচরণ কোমরে কাপড় বেঁধে তৈরী হয়ে নিল, বুক ঠুকে বলল, “এস, কে আসবে এগিয়ে এস।”

দ্বন্ধে আহ্বান অগ্রাহ্য করা যায় না, তাই বয়স্ক লোকটি তাদের মধ্যে তরুণ কুস্তিগীরকে ঠেলে দিল, বলল, “এক থাপ্পড়ে বসিয়ে দে-” তারাচরণ এক ঝট্কায় প্রথমজনকে ধরাশায়ী করল। কুস্তিগীরদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। তারাচরণের দলের ছেলেরা প্রচ- উৎসাহে কোলাহল করে তাঁকে বাহবা দিতে লাগল। কুস্তিগীর দ্বিতীয় জন এগিয়ে এল, মুহূর্তের মধ্যে তাকেও তারাচরণ পরাস্ত করল। ছেলেরা আরও প্রচ- কোলাহল করে উঠল। পাড়ার বয়স্ক নরনারীরা এসে জুটল। এই অসম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার জন্য তাদেরও উৎসাহ এবং ঔৎসুক্যের সীমা নেই। তারাচরণ তখন সিংহবিক্রমে আপন বাহুতে করাঘাত করে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, “এস, এস, আর কে আসবে এস।”

কয়েকজনকেই তারাচরণ কুস্তিতে পরাস্ত করল। আশ্চর্য্যরে বিষয়, ঐ যুবকের মধ্যে এই অপরিমেয় শক্তি কোথা থেকে এল! দর্পহারী মধুসূদন হয়ত সেই মুহূর্তে তাঁকে শক্তি জুগিয়েছিলেন। পরাজিত কুস্তিগীরগণ মাথা হেঁট করে ধীরে ধীরে সে স্থান ত্যাগ করল।

 

তারাচরণের প্রর্থনা

---------------------------------

শীতের ভোরবেলা। কুয়াশায় চারদিক ঘেরা, গাছের পাতা থেকে টুপ্ টপ্ করে শিশির ঝরে পড়ছে। অত ভোরে তপ্ত কাঁথার আবেষ্টনী ছেড়ে কেউ ওঠেনি। ঠাকুরঘরে তারাচরণের কণ্ঠধ্বনি জেগে ওঠে-

রাধে কৃষ্ণ গোবিন্দ মধুসূদন, রাম নারায়ণ হরে।

জয় শ্রীশচীনন্দন, জয় শ্রীগৌরহরি,

বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রাণ গৌরাঙ্গ নদীয়া বিহারী ॥

ওঁ জনার্দ্দন মধুসূদন, ওঁ জনার্দ্দন মধুসূদন।

হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোবিন্দ গোপাল দারুভূত মুরারি।

হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ॥

সারা বাড়ী জেগে ওঠে তাঁর এই প্রাণমাতানো কীর্ত্তনে। বৃদ্ধরা ভাবেন ছেলেটার অন্ততঃ ধর্মবুদ্ধি হচ্ছে, বজ্জাত হচ্ছে না। কিন্তু তাঁর পিতা রসিকচন্দ্র দুর্ভাবনায় পড়েন, এ ছেলে কোন কাজের হল না। লেখাপড়ায় মন নাই, সাংসারিক কোন কাজকর্ম্ম করতে চায় না। নিজের শরীরের প্রতিও যতন নাই, খাওয়া দাওয়া ভুলে যায়। মা বাপ মরলে এ ছেলে তো না খেয়ে মারা যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন পড়াশুনা হল না, তখন সংস্কৃত পড়িয়ে কবিরাজির দিকে দিলে হয়ত ভাল হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বপ্নাদেশের কথাও মানে পড়ে।

রসিকচন্দ্র একবার চন্দ্রনাথ দর্শন করার জন্য সীতাকু- গিয়েছিলেন। চন্দ্রনাথ দর্শনের পর রাত্রিবেলা রসিকচন্দ্র স্বপ্নে দেখলেন, চন্দ্রশেখর বলছেন-“আমি তোর উপর খুশি হয়েছি। তোর বাড়ীতে যাব তোর ছেলে হয়ে।” এ অপূর্ব স্বপ্নের কথা রসিকচন্দ্র বাড়ীতে এসে বললেন; কিন্তু আপনভোলা উদাসী লোকের কথা সকলে হেসে উড়িয়ে দের। রসিকচন্দ্র ভাবতে থাকেন। তারাচরণ নামকীর্তনের পরে সাজি হাতি নিয়ে ফুল তুলতে যায়। ফুল তুলতে গিয়ে প্রতি গাছকে প্রণাম ক’রে তবে ফুল ছেঁড়ে আর বিড় বিড় করে কী বলে। ফুল তুলে আনতে তাঁর কয়েকঘণ্টা কেটে যায়।

 

তারাচরণের জীবনে বিষ্ণুুপাদোদকের ভূমিকা

—————————————————

কুস্তিখেলার কয়েকদিন পরেই কিন্তু তারাচরণ হঠাৎ কলেরা রোগে আক্রাস্ত হল। কবিরাজ তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দিলেন। অন্তিম মুহূর্ত। বাড়ীতে কান্নার রোল উঠল। মায়ের আকুলি বিকুলি বেড়ে গেল, কিন্তু হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল বিষ্ণুুপাদোদকের কথা।

কয়েক বৎসর আগের কথা। ১৮০০ শকাব্দের ১৯শে ফাল্গুন পঞ্চম দোলের দিন বুধবার রাত্রে তারাচরণ যখন ভূমিষ্ঠ হল, তখন যে কান্না সুরু করল, সে কান্না কিছুতেই থামেনা। ধাই বহুরকম চেষ্টা করল, মাতৃস্তন্য কিংবা কবিরাজী ওষুধ কিছুতেই নবজাতকের কান্না থামেনা। তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেল। তখন তারাচরণের এক পিসিমার হঠাৎ খেয়াল হল, বিষ্ণুর চরণামৃত খাইয়ে দেখা যাক। ভাবামাত্র কাজ। আশ্চর্য্যরে বিষয়, চরণামৃত মুখে পড়তেই শিশুর কান্না থেমে গেল।

তাই জননী অমলা কাঁদতে কাঁদতে ভাবলেন, জীবনের ত আশা নেই। বিষ্ণুর চরণামৃতই দেওয়া যাক মুখে, শেষ মুহূর্তে কাজও হতে পারে। ভগবানের দয়ায় বাঁচতেও পারে। অমলা দেবী মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের মুখে চরণামৃত দিলেন, মনে মনে প্রার্থনা করলেন, “ঠাকুর, আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা দাও। সে তোমার কাজ করবে।”

এ সঙ্কল্প তাঁর মন থেকে আপনা আপনি এল। বিষ্ণুপাদোদক আবার তারাচরণের জীবন দান করল। কবিরাজ হাত টিপে দেখলেন, আবার নাড়ী পাওয়া যাচ্ছে, আবার বুকের ধুক্ধুকানি ফিরে এসেছে। তারাচরণ সেরে উঠল বটে, স্বাস্থ্য তেমন ফিরল না, মস্তিষ্কেরও কেমন যেন একটু বিকৃতি দেখা দিল। তাঁর আনমনা ভাব আরও বেড়ে গেল। দিনরাত চুপচাপ একস্থানে বসে থাকে, দুটো চোখ নিমীলিত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে কেটে যায়।

 

জমিদারী শাসনের ভার নিয়ে তারাচরণের ধলঘাটে পদার্পণ।

==============================

বয়স্ক ছেলের নৈষ্কর্ম্ম্য অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলল। তাঁরা স্থির করলেন তাঁকে সংস্কৃত পড়াতে হবে। ধলঘাট গ্রামে নাম-করা পন্ডিত রজনী স্মৃতিতীর্থের টোল। সেখানে জ্যেঠতুত ভগ্নীর বাড়ীতে থেকে তাঁর পড়াশোনা চলতে পারে। এ সময় আরও এক ব্যাপার ঘটে গেল। ভগ্নিপতি অন্নদাচরণ চৌধুরী আকস্মিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। পিতৃহীন নাবালক ভাগিনেয়দের ক্ষুদ্র জমিদারী দেখাশোনার লোকেরও প্রয়োজন হয়ে পড়ল। অভিভাবকগণ তারাচরণকেই সেই দায়িত্বভার দিয়ে তাঁর কর্ম্মহীন জীবনকে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। একুশ বৎসর বয়সে সংসার ও বিষয় সম্পত্তি-জ্ঞানহীন তারাচরণ জমিদারী শাসনের ভার নিয়ে ধলঘাটে পদার্পণ করল।

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ

--------------------------

একুশ বৎসর বয়সে সংসার ও বিষয় সম্পত্তি-জ্ঞানহীন তারাচরণ জমিদারী শাসনের ভার নিয়ে ধলঘাটে পদার্পণ করল। কর্ণফুলী নদীর অপর পারে কিছুদূরে ধলঘাট। বেশ বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম, শিক্ষিত ও কৃষ্টিসম্পন্ন লোকের বাস। কয়েক ঘর লোকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারীও রয়েছে। অন্নদাচরণ চৌধুরীরও কিছু জমিজমা আছে, সহৃদয় জমিদার বলে তাঁর সুখ্যাতিও ছিল, কারণ প্রজা-পীড়ন করতে তিনি ভালবাসতেন না। তাঁর অকালমত্যুতে প্রজারাও অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিল বলে, বার্ষিক ধানের তাগাদা না দিতেই তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রথম বছর জমিদারের খাজনা কিংবা রায়তী ধান দিয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় বছর থেকেই গ-গোল শুরু হল।

তারাচরণ এই জমিদারীর তদারকী করতে এসে মুস্কিলে পড়ল। না পারে ধমক দিতে, না পারে বাকী খাজনার জন্য তাগাদা দিতে। প্রজারা আর জমিদার-বাড়ীমুখো হয় না, কাজেই তারাচরণকে প্রজাদের বাড়ী বাড়ী ঘুরে খাজনা আদায় করতে হয়। কোনদিন আদায় হয়, কোনদিন হয় না, প্রজারা কোনদিন হয়ত আংশিক খাজনা দিল, বিনা আপত্তিতে তা’ নিয়েই সে বাড়ী ফিরে আসে।

পিতৃহীন নাবালক ভাগিনেয়দের জন্য তাঁর ভাবনার অন্ত থাকে না। ভাগিনেয়দের মধ্যে যামিনীরঞ্জন তখন আট বৎসরের বালক, মোহিনীরঞ্জনের পাঁচ বৎসর, দুই ভাগিনেয়ী কনকলতা ও হেমলতার যথাক্রমে সাত ও তিন বৎসর বয়স। কনিষ্ঠ রজনীরঞ্জন তার পিতার মৃত্যুর পরে ভূমিষ্ঠ হয়, তার তখন বছর খানেক বয়স। তারাচরণ তাঁর সমস্ত স্নেহ এই পিতৃহীন শিশুদের জন্য যেন ঢেলে দিল। অন্নদাচরণের মাতা বরদাসুন্দরীও তারাচরণকে পেয়ে যেন পুত্রশোক কিছুটা ভুললেন। দিনরাত তিনি ‘উমেশ’, ‘উমেশ’ করে অস্থির হন, তারাচণকে তিনি ‘উমেশ’ নামে ডাকতেন, কারণ তারাচরণ তাঁর কোন গুরুস্থানীয় ব্যক্তির নাম।

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ(পর্ব-২)

——————————————-

তারাচরণ ঘর গৃহস্থালীর কাজে মেতে উঠল, হাট-বাজারে যাওয়া, এমনকি ঘরের গরুর জন্য কচি ঘাস কেটে দেওয়া পর্য্যন্ত সে বিনা আপত্তিতে করে যেতে লাগল। গুজরায় নিজের বাড়ীতে যেখানে তাঁকে কাজ করতে বললে বিরক্ত হত, ধলঘাটে এসে তাঁর সেই নৈষ্কর্ম্যরে ভাব কেটে গেল। দিনরাত কাজ, কাজ আর কাজ। নিজের জন্য নয়, শুধু পরের জন্য কাজ, কোন কিছুর প্রত্যাশা না করে কাজ।

হাটে বাজারে গেলে শুধু দিদির বাড়ীর নয়, পাড়াপড়শি যারা বাজার করে আনার জন্য পয়সা দিত, তাদের বাজারও বিনা দ্বিধায় তারাচরণ ব’য়ে নিয়ে আসত। কিন্তু সেখানেও সত্য থেকে ভ্রষ্ট হতো না। কোন বস্তুর প্রতি লোভ কিংবা অর্থের আকাক্সক্ষা ঐ সময় থেকেই তাঁর ছিল না।

জমিদারী শাসন ব্যাপারেও একটা অদ্ভূত জিনিস দেখা যেত। জমিদারী-সংক্রান্ত মোকদ্দমায় তারাচরণ কিছুতেই মিথ্যা বলত না। মিথ্যা বললে হয়ত নিজেদের একটু সুবিধা হয়, কিন্তু তাতেও সে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হ’ত না। হাজার প্রলোভন দেখিয়েও অপর পক্ষ নিজেদের সুবিধার জন্য তাঁকে দিয়ে মিথ্যা বলাতে পারত না। সত্যকথা বলতে গিয়ে বহু মামলায় তারাচরণ হেরে যেত। বরদাসুন্দরী বিরক্ত হতেন, মাঝে মাঝে জমি জায়গা হারাতেও হতে বলে। বরদাসুন্দরী রাগে মাথার চুল ছিঁড়তেন, কিন্তু তারাচরণকে সত্যপথ থেকে বিচলিত করা যেত না। তারাচরণ বুক চাপড়ে বলত, “প্রাণ যায় যাক, তবু মিথ্যা কথা বলব না।”

তারাচরণের বেশভূষায় কোন পারিপাট্য নাই, একখানা আধমলিন বস্ত্র পরিধানে, গায়ে একখানা আধমলিন চাদর কিংবা ফতুয়া। নগ্নপদ, চুলদাড়ি উস্কখুস্ক, দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে। তাঁর সঙ্গে হেঁটে কেউ পারে না, সহযাত্রিদের সে বহু পিছনে ফেলে যায়। কোন কাজ করতে হলে অত্যন্ত দ্রুত কাজ সম্পাদন করে।

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ(পর্ব-৩)

——————————————-

স্ত্রীলোকের প্রতি একটা অপরিসীম শ্রদ্ধার ভাব। স্ত্রীলোকের পা ভিন্ন মুখের দিকে তারাচরণ কখনও তাকায় না, সকলকে সে মাতৃ সম্বোধন করেন। ব্রহ্মচারী তপস্বীর মত তাঁর কঠোর সংযম ও নিষ্ঠা, বিশেষতঃ নির্জ্জনে বসে তাঁর আত্মধিক্কার গ্রাম্য যুবকদের হাসির খোরাক হয়ে উঠল।

ধলঘাটের বিখ্যাত রজনী স্মৃতিতীর্থের টোলে তারাচরণ ভর্ত্তি হয়ে সংস্কৃত পড়াশুনা সুরু করল। পন্ডিতগণ বিষ্মিত হলেন এই আধ-পাগলা যুবকের তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে। তাঁর অপূর্ব্ব সরলতা ও সত্যনিষ্ঠার জন্য অল্পদিনের মধ্যে সে পন্ডিতদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। কিন্তু পড়তে পড়তে তারাচরণ আবার পূর্ব্বের পাগলামি সুরু করল। সে এক অক্ষরের উপর মন সংস্থাপন করে বুঁদ হয়ে বসে থাকে, ঐ সময় তাঁর যেন বাহ্যজ্ঞান থাকে না। একবার সন্ধ্যার পূর্বে তারাচরণ টোল থেকে ফিরছিল। মাথায় কী একটা সংস্কৃত শ্লোকের ভাবার্থ নিয়ে সমস্যা, পন্ডিতদের সঙ্গে মতবিরোধ। তা ভাবতে ভাবতে কখন যে এক পুকুরের জলে নেমে গেছে, তাঁর খেয়াল নেই। একগলা পর্য্যন্ত জলে নামার পর কোনও পথচারীর চীৎকারে তাঁর সম্বিৎ ফিরে আসে।

গীতা ও চণ্ডী পাঠ করতে করতে তারাচরণের বহু রাত্রি কেটে যায়। পাঠও সেই প্রকার, এক অক্ষরের উপর মনঃসংযোগ।

একবার বাড়ীতে অন্নপ্রাশনের উৎসব। সন্ধ্যার সময় নিমন্ত্রিত অভ্যাগতগণ আসবেন, ঢুলিরা এসে বাদ্য বাজাবে। তাদের সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে তারাচরণ বিষ্ণুমণ্ডপে বাঁশের ঝাঁপ বন্ধ করে চণ্ডী পাঠ করতে বসল। শীঘ্র শীঘ্র চণ্ডীপাঠ শেষ করে উঠতে হবে। কিন্তু এক অক্ষরে মনঃসংযোগ করে কখন একসময় তারাচরণ ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ল। নিঃসাড় নিস্পন্দ দেহ।

ধ্যান যখন ভাঙ্গল, তখন রাত গভীর হয়েছে। নিমন্ত্রিতগণ এসে ভোজন সেরে চলে গেছে। ঢুলিরা প্রচ- রবে ঢোল ও কাঁসি বাজিয়ে খেয়ে দেয়ে বিদায় নিয়েছে। এই তুমুল হট্টগোল ধ্যানমগ্ন তারাচরণের কানে প্রবেশ করেনি। বিষ্মিত হয়ে বোকার মত সে জিজ্ঞাসা করল-“ঢুলিরা আসেনি?” বরদাসুন্দরী কপাল চাপড়ান, “হায়রে! এ ছেলেকে নিয়ে কী হবো।”

জয় শ্রী শ্রীৎ তারাচরণ পরমহংসদেব।

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ(পর্ব-৪)

—————————————

চৌধুরীদের শ্মশান-শিবের মন্দির; মন্দিরের পিছনে দল ও জঙ্গলাকীর্ণ দীঘি, সম্মুখে ক্ষুদ্র পুষ্করিণী, তার পাড়ে বাঁশবনের নিবিড় ছায়া। পুকুরের জলে স্নানার্থিরা স্নান সারে,গ্রাম্যবধুরা কলসী কাঁধে জল নিয়ে ফিরে। নির্জ্জন নীরব চারিধার। মন্দিরে শ্মশানেশ্বর শিবলিঙ্গ ও জ্বালাকুমারীর মূর্ত্তি। পুরোহিত দুবেলা পূজা ও আরতি সেরে চলে যান।

তারাচরণ এই শিবমন্দিরে অনেকক্ষণ অতিবাহিত করে। পুকুরের জলে গলা পর্যন্ত ডুবে আপনমনে কথা বলে, দুহাত দিয়ে বারবার জল আন্দোলিত করে আর ডুব দেয়। মিনিটে মিনিটে ডুব দেয়। সারা গায়ে, জিহ্বায়, মাটি ঘষে আবার জলে নামে আর ডুব দেয়। পূর্ব্বে তিনবার স্নান করত, এখন কতবার স্নান করে তার অন্ত নেই। আর স্নানে নেমে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে স্নান করে। সারা দেহে অসহ্য জ্বালা, শতবার স্নানেও যেন যায়না।

পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। পাগলের মত উস্কখুস্ক ভাব। জমিদারীর কাজকর্ম্ম কিংবা সাংসারিক বিষয়ের তদারকও আর তেমন করেনা। আহার নিদ্রারও খেয়াল নেই। জোর করে ধরে খাওয়াতে হয়। খাবার পরে গলায় আঙ্গুল দিয়ে সব বমি করে ফেলে। রাত্রিবেলা গুমরে গুমরে কাঁদে। কপাল ঠুকে ঠুকে কপাল কেটে বক্ত ঝরে। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, “আমার প্রাণ যায়।”

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ(পর্ব-৫)

—————————————

বাড়ীর লোকেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। প্রতি রাত্রে এই করুণ কান্নার কারণ কিছু না বুঝে তারা চিকিৎসার চেষ্টা করল। ভাগিনা যামিনীরঞ্জন উঠে গিয়ে মাথা গরম হয়েছে মনে করে মাথা ধুইয়ে দিত এবং কবিরাজের নির্দেশমত বায়ুরোগের জন্য মধ্যমনারায়ণ তেল দিয়ে মাথা ভিজিয়ে দিত। তাতে সাময়িক একটু নিবৃত্তি হলেও যামিনীরঞ্জন যে মুহূর্তে শয়ন করতে যেত, তার পরক্ষণেই আবার কান্না সুরু হত।

কোনদিন কাঁদতে কাঁদতে তারাচরণ ঘরের বাহিরে চলে যেত। অত গভীর রাত্রে কেউ তাঁর অনুসরণ করতে সাহস করত না। সারা রাত্রি সে কোথায় কাটাত কেউ জানে না। ভোরবেলা দেখা যেত শিবমন্দিরের পুষ্করিণীতে জলে নেমে সে স্নানে রত। কী গ্রীষ্ম, কী শীত, কী বর্ষা সারা বৎসর ধরে চলত তাঁর এই পাগলামি। সকালে জানল তারাচরণের বায়ুরোগে মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। বরদাসুন্দরী চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করলেন, তাঁর মনে নিদারুণ দুঃখ হলো, পরের ছেলেকে এনে নিজের মাতৃহৃদয়ের স্নেহছায়ায় রাখলেন, তাও ভগবান সইলো না। তাঁকেও পাগল করে দিল।

 

সাধন-ভূমি ধলঘাটে তারাচরণ(পর্ব-৬)

—————————————

গ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল ‘তারা পাগলা’। ‘তারা পাগলা’ রাস্তায় বেরোলে গ্রামের বালকেরা তাঁর পেছনে লাগে, তাঁকে ক্ষেপায় ‘তারা পাগলা’ ‘তারা পাগলা’ বলে। তারাচরণও তাদের ভয় দেখায়, মুখ ভেঙচে তাড়া করে।

একদিন বালকেরা একটা অদ্ভূত ব্যাপার আবিষ্কার করল। ‘তারা পাগলা’ পুকুর পাড়ে বাঁশঝোপের নীচে বসে আছে-সামনে এক স্তূপ বিষ্ঠা আর এক স্তুপ মাটি। ‘তারা পাগলা’ একবার বিষ্ঠা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কী বলে, আবার মাটি হাতে নিয়ে কী বলে। অনেকক্ষণ এরূপ করার পর বিষ্ঠা মুখে পুরে দিল, আবার পরে মাটি মুখে নিল এবং বারবার এইরূপ একবার বিষ্ঠা একবার মাটি মুখে নিতে লাগল।

বালকেরা ত হতভম্ব। ঘৃণাত্যাগের এরূপ অনন্যসাধারণ কা- দেখে তারা বিস্ময়-বিমূঢ়। পাগলাটার আবার হল কী? তারা কিছুতেই বুঝতে পারল না এত ভাল ভাল খাবার থাকতে পাগলাটা কুকুরের মত বিষ্ঠা খায় কেন?

তারাচরণ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বালকদের দিকে ছুটে গেল। বালকেরা ছুটে পালাল। দূর থেকে তারা দেখল, পাগলা পুষ্করিণীর জলে নেমে মাটি দিয়ে জিভ ঘষতে সুরু করেছে। তারপরে সারা গায়ে মাটি মেখে শিব হয়ে বসে আছে। ‘তারা পাগলার’ কথা সারা গ্রামের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ পরমহংসদেবের বিবাহ(পর্ব-১)

--------------------------------------------------

এ ছেলের বিয়ে না দিলে সর্বনাশ হবে। অভিভাবিকা বরদাসুন্দরী বলে পাঠালেন বৈবাহিক রসিক দত্তের কাছে। অমলা ছেলের মস্তিষ্ক-বিকৃতির কথা শুনে চিন্তÍায় পড়লেন, কী করা যায়। রসিক দত্ত মশায় মেয়ের খোঁজে রইলেন, একটা সম্বন্ধ পেয়েও গেলেন।

ধলঘাটের নীলমণি চৌধুরীর মেয়ে। বয়স পনেরো-ষোল হবে। তখনকার দিনের আন্দাজে বয়স একটু বেশি বটে কিন্তু খুব কাজের মেয়ে। গৃহদেবতা দশভূজার পূজার কাজকর্ম্ম সব মেয়েটিই করে। বাড়ীর অর্দ্ধেক কাজকর্ম্ম সে একা সারে, গরুর সেবা থেকে শুরু করে গুরুজনের সেবা পর্য্যন্ত।

আর কোন কথা নয়, মেয়ে যখন পছন্দ হল, বিয়ের তারিখও ধার্য্য হয়ে গেল ১৩১১ বঙ্গাব্দের ২১ শে বৈশাখ। কন্যাপক্ষ কিছু তেমন দিতে পারবে না ব’লে ছেলের বাড়িতেই কনে নিয়ে গিয়ে বিবাহের কথা স্থির হল।

কিন্তু বিপদ ঘটল তার পূর্ব্বে। কনে নিয়ে নৌকা ভীষণ তরঙ্গসঙ্কুল কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে গেল, হাঙ্গামা ঘটল নিস্তরঙ্গ হালদা নদীতে। যেখানে হালদা নদী এসে কর্ণফুলীতে মিশেছে, সেই মোহনার সামান্য ভিতরে হঠাৎ যাত্রীসহ নৌকা উল্টে গেল। বিবাহের যাবতীয় উপকরণ গেল ভেসে। সঙ্গী লোকজন, ঢুলিরা ঢোলসমেত স্ত্রোতের মুখে তৃণের মত ভেসে গেল। আশ্চর্যের বিষয় ছোট্ট কনেটির কিছু হল না। কনে উল্টানো নৌকার উপরে উঠে চুপ করে বসে রয়েছে।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ পরমহংসদেবের বিবাহ(পর্ব-২)

--------------------------------------------------

বিবাহে তারাচরণের ভয়ানক আপত্তি। কিন্তু মা বলেছেন- “আমি আর রান্না করতে পারি না, তারা। তুই আমাকে বৌ এনে দে।” তারা বলল, “তুমি যদি খুশি হও, তাহলে তাই হবে।”

তাঁর সম্পূর্ণ অনিচ্ছা, কিন্তু উপায় নাই, মায়ের আদেশ পালন করতে হবে। নিজের বিবেকের সঙ্গে সংগ্রাম করে সে রক্তাক্ত হয়ে উঠল।

বিবাহ অনুষ্ঠানে সকলে উৎফুল্ল, কিন্তু তারাচরণ বিষন্ন। বিবাহ বেদীতে কোনমতে দাঁড়াল, কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিতে বললে বসনে চোখ ঢাকল, স্ত্রীলোকের মুখ সে দর্শন করে না। তাঁর বড় বৌদি তাঁর আঙ্গুলে সিঁদুর মাখিয়ে জোর করে কনের ললাটে সিঁদুরের রেখাপাত করে দিল।

এই পর্যন্ত তারাচরণ সব সহ্য করল, কিন্ত স্ত্রীলোকেরা যখন বাসরের ব্যবস্থা করল, তখন তারাচরণ বাড়ী থেকে উধাও হয়ে গেল। সে রাত্রে আর তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। তার পরের কয়েকদিনও না।

বিবাহের আনন্দোৎসবে নিরানন্দ নেমে এল। বাড়ী ভরা আত্মীয়স্বজন ও নিমন্ত্রিত নরনারী নববধূর হতভাগ্যের জন্য তাঁকে ধিক্কার দিচ্ছিল অলক্ষুণে বলে। কেউবা সমবেদনায় গলে পাগলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে ছোট মেয়েটিকে কোলে টেনে নিয়েছিল। কিন্তু শক্ত মন নববধূ অরণ্যকুমারীর, তাঁর চোখে নাই জল, মন যেন তৈলাক্ত পিচ্ছিল, জল সেখানে কোন ঠাঁই পাচ্ছে না। আধহাত লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখখানা ঢেকে সে নিব্বির্কার হয়ে বসে থাকে।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ পরমহংসদেবের বিবাহ(পর্ব-৩)

--------------------------------------------------

তারাচরণ বিবাহের বেদী থেকে সেই যে পলায়ন করল, বহুদিন আর গুজরায় ফিরল না। কোথায় রইল বাসর আর কোথায় রইল নববধূ! তাঁর এই পাগলামির জন্য ধলঘাটেও তাঁকে কথা শুনতে হল প্রচুর। বরদাসুন্দরী তাঁকে কত বোঝালেন, কত সাধ্যসাধনা করলেন। কিন্তু তারাচরণ পাথরের মত মূক ও মৌন। গালাগালির মাত্রা যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন সে স্থান সে নীরবে পরিত্যাগ করে।

ক্রমে তারাচরণের পাগলামি যেন আরও বেড়ে গেল। দিনরাত ঘরের বাইরেই বেশি সময় কাটায়। ধলঘাটের বুড়াকালী মন্দির তাঁর “মা, মা, মা” ক্রন্দনে অনুরণিত হতে থাকে। বুড়াকালীর সামনে মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে কপাল কেটে রক্ত বের হয়। উপস্থিত শ্রোতাদের চোখও অশ্রু-সজল হয়ে ওঠে। তাঁর এই আকুল অপার্থিব কান্নাকেও লোকে আর একটা পাগলামি ভাবল। তবু বুড়াকালীর মন্দিরে নরনারী জমায়েত হয়ে দিনের পর দিন এই ব্যাকুল রোদন স্তব্ধ হৃদয়ে শুনতে লাগল।

 

শ্রীশ্রীবুড়াকালীর মন্দিরে শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ (পর্ব-১)

-------------------------------------------------------

ধলঘাটের প্রসিদ্ধ বুড়াকালীর মন্দির। বুড়াকালী জাগ্রত দেবতা। বহুদূর থেকে যাত্রীরা আসে, পূজা দেয়, মানত শোধ করে। মন্দিরের পিছনে হারগেজী নদী কুলকুল রবে বয়ে গেছে। পাশে শিবমন্দির; সম্মুখে বৃহৎ প্রাঙ্গণের দুপাশে দুটো প্রাচীন বট ও অশ্বত্থগাছ, শাখায় প্রশাখায় এ স্থানটিকে ছায়া-সুনিবিড় করে তুলেছে। দুপাশে দুটো পুষ্করিণীর পাড়ে ঘন জঙ্গল, দিনের বেলা শেয়াল ঘুরে বেড়ায়, সাপখোপের ভয় ত' আছেই।

মন্দিরও ভগ্নপ্রায়, মন্দিরের অভ্যন্তরে আলো নাই, ক্ষুদ্র বাতায়ন-পথে যেটুকু আলো আসে তাতে আলো আঁধারির খেলায় অস্পষ্টতা আরও বেড়ে ওঠে। এ অন্ধকার প্রচ্ছদপটে বুড়াকালীর মূর্ত্তি প্রথম দর্শকের মনে ভীতির সঞ্চারই করবে। বুড়াকালী সম্বন্ধে বহু প্রবাদ প্রচলিত আছে। বালিকার বেশে দেবী নাকি গ্রাম গ্রাম প্রদক্ষিণে বের হতেন। একবার গ্রামের এক বালিকার সহিত দেবী তাঁর স্বর্ণবলয় বদল করেছিলেন। বালিকার মাতা চুরির অপরাধে বালিকাকে তিরস্কার করলে সে বলে যে, সে চুরি করেনি, কালোবরণ একটা ছোট মেয়ে তার হাতের চুড়িগুলির বদলে সোনার অলঙ্কারটা দিয়েছে। বালিকার মা জানে যে এ বুড়াকালীর হাতের অলঙ্কার! ছুটে সে মন্দিরে গিয়ে দেখে যে বুড়াকালীর হাতে তার মেয়ের চুড়িগুলি শোভা পাচ্ছে। অবশ্য ঐ মেয়ে কদিন পরেই হঠাৎ মারা যায়।

 

শ্রীশ্রীবুড়াকালীর মন্দিরে শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ (পর্ব-২)

----------------------------------------------------

প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্ব্বে রাজারাম দত্ত স্বপ্ন দেখেন যে, কালী তাঁকে আদেশ দিচ্ছেন, এক নিমগাছের ভিতরে তিনি আবদ্ধ হয়ে আছেন, রাজারাম যেন তাঁকে বাহির করে প্রতিষ্ঠা করেন। সারা গ্রাম খুঁজে অবশেষে এক নাপিতের বাড়ীতে রাজারাম তাঁর স্বপ্নদৃষ্ট নিমগাছ দেখতে পেলেন। টাকা দিয়ে সেই নিমগাছ কিনে রাজারাম সেই গাছ থেকে কালীর মূর্ত্তি খোদিত করান। তাঁর পিতৃমাতৃ-শ্মশানের উপর মন্দির নির্ম্মাণ করে সেখানে দেবীর মূর্তি স্থাপিত করেন। কিন্তু ক্রমে নিমকাঠ শুষ্ক হয়ে যায়, দেবী বৃদ্ধার মূর্ত্তি পরিগ্রহ করেন। মুখ ভেঙ্গে কুঁচকে গিয়ে বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে যা দিয়ে দীর্ঘ লোল জিহ্বা চেপে ধরেছেন। বিশাল আয়ত চোখ দুটোও কোটর কেটে গিয়ে আরও বৃহৎ এবং আয়ত হয়েছে। কোমর ভেঙ্গে বেঁকে গেছে, বাহুযুগল শীর্ণ হয়ে পড়েছে। কৃশ দুখানি চরণ নিয়ে শিবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। তখন থেকেই দেবী বুড়াকালী নামে অভিহিতা হলেন।

 

শ্রীশ্রীবুড়াকালীর মন্দিরে শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ (পর্ব-৩)

---------------------------------------------------

তারা পাগলা দুবেলা স্নানের পর বুড়াকালীর পূজা ও আরতির সময় দেবীর সম্মুখে ‘মা, মা’ রবে আকুল রোদন করতে থাকে। সে কান্নায় পাষাণও বুঝি গলে যায়। মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে কপাল কেটে রক্ত বাহির হয়, অশ্রুর ধারায় মেদিনী সিক্ত হয়ে ওঠে। এত অশ্রুজল ঝরত যে, মনে হত যেন কেউ একঘটি জল ঢেলে দিয়েছে। আর কোন মন্ত্র নাই, কোন অনুষ্ঠান নহি, শুধু ব্যাকুল বোবা কান্না মন্দিরের ভিতরে গুম্রে গুম্রে উঠত। আর কান্নার সাথে সাথে চলত তাঁর রোদন-সঙ্গীত-

ও মা, মা, মা, মা, মা, মা, মা ভবের জননী!

অশ্রুজলে ধোয়াইব, কেশ দিয়ে মুছাইব; চরণ দু’খানি।

ভেঙ্গে গেছে মোর সোনার স্বপন; ছিঁড়ে গেছে মোর বীণার তার

হৃদয় ভেদিয়া উঠিছে আমার; মর্ম্মভেদী হাহাকার।

কত যে কাঁটা ফুটেছে পায়; কত যে আঘাত লেগেছে গায়

মরমে পেয়েছি বেদনা আমি।

সকলেরি সুখে বঞ্চিত হইয়ে; সকলেরি প্রেমে লাঞ্ছিত হইয়ে

মা জননী, তোমারেই ভালবেসেছি।

এসেছি অবেলায় অপরাধী-প্রায়; তোমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

তোমাতে যখন মজে আমার মন; কিছুতেই মন ভাল লাগে না।

ভুবন স্বপন হয় সমজ্ঞান; ধরা কারা বিষম সমান।

আটঘাট বাঁধা মায়ার শিকলি; ওই অসিধারে ছিন্ন সকলি।

রিপুচয় পরাজয়; দশেন্দ্রিয় থাকে শূন্যেতে মগন।

আমি অশ্রুসিক্ত মনোবেদনা-অর্ঘ্য; বহুদূর হতে বহিয়ে এনেছি।

লহ, লহ, তুমি আমার জীবনের ভার।

তুমি যে আমার, আমি যে তোমার; চিনেছি তোমারে আমি।

তোমার মন্ত্র তুমি জপ; তোমার পূজা তুমি করো

এসো মা তুমি।

সন্ধ্যা পূজা সকল ফেলে; কাঁদবো আমি ‘মা, মা’ বলে

দেখবো শিবে দয়া আছে কিনা; তোমার অন্তরে।

পিরীতি সুজন, পিরীতি কুজন; পিরীতি মায়ের খেলি।

আঙ্গুল কাটিয়ে কলম বানিয়ে; নয়নের জলে কালি,

হৃদয় ছিড়িয়ে পত্র না লিখিয়ে; পাঠাব মায়ের বাড়ী।

মাগো, তুমি কালাচাঁদ, নাগর চাঁদ; তুমি প্রেম পারাবার।

এসেছি অবেলায় অপরাধী-প্রায়; দাঁড়ায়ে রয়েছি দুয়ারে তোমার।।

 

শ্রীশ্রীবুড়াকালীর মন্দিরে শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ (পর্ব-৪)

---------------------------------------------------

মন্দিরের বৃদ্ধ পূজারী প্রথম প্রথম বিরক্ত হয়ে উঠতেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে ‘তারা পাগলা’ শুধু দুবেলা নিজের কান্না কেঁদে যায়, তাঁর পূজার কোনপ্রকার বিঘ্ন সম্পাদন করে না, তখন বৃদ্ধ পূজারীও সে কান্নার মধ্যে পূজা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। একদিন এরূপ কান্নার পর ‘তারা পাগলা’ ছুটে গিয়ে বুড়াকালীর চরণে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। কাষ্ঠ-নির্মিত চরণে মাথা ঠেকতেই তাঁর অনুভব হল যেন দেবীর চরণ নরম তুলতুল করছে। ব্যাকুল আগ্রহে অপর চরণ স্পর্শ করা মাত্র অনুভব করল সেই চরণখানিও নরম তুলতুল করছে। মাথা তুলে মুখের দিকে তাকাল সাধক, দেখল মায়ের ভূবন-ভুলানো হাসি। মায়ের সঙ্গে সাধক কথাবার্তা শুরু করল। তাঁর আনন্দ আর ধরে না। ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা! কালীমন্দিরের মালিকদের কয়েকজন ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। ব্রাহ্মণ ছাড়া কায়স্থ দেবমূর্তি স্পর্শ করলেই দেবতা অপবিত্র হয়ে যায়। সুতরাং পাগলের পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়া সমীচীন হবে না। তাই বিগ্রহ স্পর্শ না করার জন্য ‘তারা প্রাগলা’র উপর নির্দ্দেশ দেওয়া হল। তারাচরণ উত্তর দিল, “কালীকে আমি সর্বত্র পাব। মন্দিরে যাবার আমার প্রয়োজন হবে না।” সকলে মনে করল, এটা উন্মাদের দাম্ভোক্তি।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-১)

-------------------------------------------

তারাচরণ মাঝে মাঝে ঘরবাড়ী ছেড়ে কোথায় চলে যায়। সাতদিন দশদিন আর তাঁর কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। বরদাসুন্দরী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, কোথায় গেল ছেলেটা! চোখের সামনে পাগলামি করে তবু সহ্য হয়, কিন্তু কোথায় কোন বেঘোরে পড়ে আছে, না খেয়ে না দেয়ে কী ভাবে কাটাচ্ছে-সেকথা ভাবতেও অসহ্য লাগে! ‘উমেশের’ জন্য বৃদ্ধার চোখে জল ঝরে।

ধলঘাটের, পূর্ব্বদিকে চার মাইল দূরে পর্বতশ্রেণী, লুসাই পর্বতেরই কোন শাখা প্রশাখা হবে। এরূপ একটি পাহাড়ের মাথায় মেধস মুনির আশ্রম। মন্দিরে কালী ও দুর্গার মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত। শীতলানন্দ বেদান্তবাগীশ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই লুপ্ত স্থানটি উদ্ধার করেন। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দানে আশ্রমে মন্দির ও অন্যান্য গৃহ নির্মিত হয়।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-২)

-------------------------------------------

তারাচরণ প্রায় মেধস আশ্রমে এসে কয়েকদিন যাপন করে যেত। মেধস আশ্রমের কিছুদূরে মাইছ্ভাণ্ডর গ্রাম। এ গ্রামে থাকতেন বিখ্যাত ফকীর আহম্মদুল্লা। ফকীর আহম্মদুল্লার খ্যাতি তখন বহুদূর বিস্তৃত, কর্ণফুলীর ও’পার থেকেও লোক তাঁর কাছে যাতায়াত করে। তাঁর বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য।

তারাচরণ আহম্মদুল্লাকে দর্শন করতে যায়। বাড়ীর ফটকে যখন তারাচরণ পৌঁছাল, ফকীর তখন ঘরের ভিতরে ছিলেন। তিনি ছুটে বেরিয়ে এলেন, দুহাতে লোকজন সরিয়ে তারাচরণকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ফকীরের খুশি আর ধরে না। হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে চট্টলী ভাষায় বলতে লাগলেন-“উদয় হয়েছে রে, উদয় হয়েছে।” তারপর তারাচরণের কপালে স্নেহভরে একটা চুমো খেলেন। ফকীরের ভক্ত এবং অন্যান্য লোকজন ত অবাক একটা অচেনা লোককে নিয়ে ফকীরের এত নাচন কেন, এত সমাদর কি জন্য? কিন্তু তারা জানে যে ফকীর খাঁটি লোককে সমাদর করেন, হাজার হাজার লোকের মধ্যে দু একজনের ভাগ্যে এরূপ সম্মানলাভ ঘটেছে। অবশ্য তারাচরণের দুই চোখের তীব্র জ্যোতি দেখে তারা কতকটা আন্দাজ করল যে সাধারণ বেশভূষা-পরিহিত এ লোকটিও সাধারণ মানুষ নয়।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৩)

-------------------------------------------

সাধুবাবা এই মহাপুরুষ (ফকির আহম্মদুল্লা) সম্বন্ধে সুন্দর সুন্দর কাহিনী বলতেন। একবার এক মুমূর্ষু শিশুকে নিয়ে তার পিতা ফকীরের কৃপা ভিক্ষা করতে যায়। অনেক ছেলে মারা যাবার পর এটি তার শেষ সম্বল। কবিরাজ ছেলের আশা ছেড়ে দিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সকল আশা যখন শেষ, তখন একবার ফকীরের কাছে ধরনা দেওয়া যাক। বাপ ফকীরকে বলল, “ছেলেকে তোমার পায়ে দিলাম, তুমি যা করবার কর” ফকীর ছেলের বাপকে জিজ্ঞাসা করলেন “তোর ছেলেরে আমারে দিলি ত? ”

বাপ মাথা নেড়ে বলল,“হাঁ”।

ফকীর তখন শিশুটির পা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সামনে এক পুকুরের কোলে। জলে পড়ে, জল খেয়ে ছেলে যখন ডুবে যাচ্ছে, ফকীর বাপের মুখের দিকে তাকালেন। বাপ বলল-“ফকীর, তুমি যা বোঝ কর।” ফকীর তখন ছেলেটিকে তুলে আনলেন, তারপর পা ধরে বন্ বন্ করে এক চক্কর ঘুরিয়ে দিলেন। ছেলেটি বমি পায়খানা করে কাহিল হয়ে পড়ল । সকলে অবাক হয়ে দেখছে ফকীরের কণ্ড। ফকীর ছেলের বাপকে বললেন, “নিয়ে যা, ভাল হয়ে গেছে।” ছেলে তারপর থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। এইরূপ আরও কত যে ঘটনা আছে, তার অন্ত নাই।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৪)

-------------------------------------------

মুসলমান ফকীরদের প্রতি তারাচরণের শ্রদ্ধার সীমা ছিল না। ফকীরেরাও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। চট্টগ্রামের আর একজন বিখ্যাত ফকীর শৈর আলি সাহেব প্রায়ই ধলঘাট আসতেন। এই মৌনী ফকীরের সঙ্গে তারাচরণের ইঙ্গিতি সব কথাবার্তা হত। এই সময় তারাচরণ বোধ হয় ইসলামীয় রীতিতে উপাসনা করতে থাকেন। তাঁর এক জ্যাঠতুতো ভাই ও বাল্যবন্ধু অম্বিকা চরণ দত্ত মহাশয় এই ঘটনাটি বর্ণনা করেন। “একদিন অপরাহ্নে সূর্য্য অস্তপ্রায়, পশ্চিমাকাশে রঙের হোলিখেলা। তারাচরণের সঙ্গে অন্বিকাচরণ কোথায় যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দূরে মসজিদ থেকে আজানের ডাক শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে তারাচরণ কাছা খুলে কানে হাত দিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে নমাজ পড়তে সুরু করলেন। অন্বিকাচরণ ত' থ মেরে গেল, হিন্দুর ছেলে নমাজ পড়ে! জাত যে গেল! তারা পাগলার যে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেছে সে ধারণাই দৃঢ়তর হল।

পরে সাধুবাবা বলতেন, এই সময় তিনি জ্যোতি দর্শন করেন। এক অখ- সচ্চিদানন্দ প্রবাহে তিনি ভেসে যান, জ্যোতির সমুদ্রের মধ্যে তিনি শুনতে পান, তাঁর উপর আদেশ হল, “তুই সত্য নিয়ে থাক”।

বুড়াকালীর মন্দিরে দুবেলা ব্যাকুল কান্নার মধ্যেও তারাচরণ শুনতে পেলেন, একই কথার পুনরাবৃত্তি, “তুই সত্য নিয়ে থাক”। তাই পরে দেখা যায়, তিনি সর্বত্র সত্যধর্মের প্রচার করে গেছেন, বলেছেন, “সত্যই ধর্ম। সকল ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে।” সকল ধর্মের লোককে তিনি কোল দিয়েছেন এবং শরণাগত ভক্তের জন্য নিজের দেহকে তিল তিল করে বিলিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “এ দেহকে হোম করে যাব, তাতেও যদি কারো উপকার হয়”। ভক্তের দুঃখ, ভক্তের সন্তাপ, তিনি তাঁর অমৃত পরশ বুলিয়ে দূর করে দিয়েছেন। ভক্তদের সকল জ্বালা, দেহের হোক মনের হোক, নিজে গ্রহণ করে তাদের শান্তি দিয়েছেন।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৫)

-------------------------------------------

সিদ্ধ সাধকদের চারি প্রকার অবস্থার কথা শাস্ত্রে বর্ণিত আছে-জড়বৎ, বালকবৎ, উন্মাদবৎ ও পিশাচবৎ। সাধারণ লোক এ অপূর্ব অবস্থা বুঝতে পারে না। যাঁরা ঐ পথের পথিক তাঁরা এইসব ভাবাবেশ দোখে আকৃষ্ট হন, মধুর লোভে অলির মত।

যামিনীরঞ্জনের প্রতিবেশী-এক গোষ্ঠীরও বটে, আশুতোষ দাস। প্রথম জীবনে প্রিয়তমা সুন্দরী পত্নীর মৃত্যুর পর শ্মশানেই আশুতোষ বাস করতে থাকে। সংসারের প্রতি সে উদাসীন হয়ে পড়ে। ক্রমে তাঁর মধ্যে উন্মাদের লক্ষণ দেখা দেয়। আশু উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কোনদিন বা ছিন্ন কটিবাস পরিধান করে পড়ে থাকে। অনাহারে কয়েকদিন কেটে যায়। তারপর একদিন দেখা যায়, গ্রামের কারো বাড়ী থেকে পান্তাভাত ও তরকারী ভিক্ষা করে এনে বসে বসে খায়- আপনমনে হাসে, কথা বলে আর খায়। তাঁর সঙ্গী তিন চারটা কুকুরও একই পাত্র থেকে অন্ন গ্রহণ করে। মাঝে মাঝে আশুতোষ হরিনাম করে। সারারাত্রি হরিবোল, হরিবোল করে আশু নৃত্য করতে থাকে, নাম করতে করতে জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত আশুতোষের নৃত্য থামে না।

এই ‘আশু পাগলা’ তারাচরণের কাছে এসে হাত জোড় করে বলে, “কৃপা কর, কৃপা কর।” দুজনে আপন মনে পাগলামি হাসি হাসে, বিড় বিড় করে কথা বলে। সকলে দুই পাগলের মিলন দেখে মুচকে হাসে। এই আশু পাগল হয়ত তখনই তারাচরণকে চিনতে পেরেছিল।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৬)

-------------------------------------------

‘আশু পাগলা’ তারাচরণের কাছে এসে হাত জোড় করে বলে, “কৃপা কর, কৃপা কর।” দুজনে আপন মনে পাগলামি হাসি হাসে, বিড় বিড় করে কথা বলে। সকলে দুই পাগলের মিলন দেখে মুচকে হাসে। এই আশু পাগল হয়ত তখনই তারাচরণকে চিনতে পেরেছিল।

আর একজন ছিলেন গ্রামের প্রসিদ্ধ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার সারদাচরণ চৌধুরী। তিনি যোগমার্গে সাধন ভজন করতেন। তন্ত্রশাস্ত্রেও তার পাণ্ডিত্য ছিল। ফর্সা রং, মাথার সব চুল সাদা, দুচোখে ছিল একটা তির্য্যকভাব। তিনি তারাচরণের পাগলামিকে একটু অন্যচোখে দেখতেন। প্রায়ই তারাচরণ ও তাঁর মধ্যে আলাপ আলোচনা হত। নিরীহ গ্রামবাসীগণ তা বুঝতো না।

তারাচরণের স্বচ্ছ দৃষ্টিকে তাই সাধারণ লোক ভুল বুঝত। তারাচরণ যেন দেখতে পেত অনাগত ভবিষ্যতকে। কোন বিপদের ছায়াপাত দেখলেই সে পূর্বে সাবধান করে দিত। সকলে সেটাও মনে করত পাগলামী।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৭)

-------------------------------------------

তারাচরণের স্বচ্ছ দৃষ্টিকে তাই সাধারণ লোক ভুল বুঝত। তারাচরণ যেন দেখতে পেত অনাগত ভবিষ্যতকে। কোন বিপদের ছায়াপাত দেখলেই সে পূর্বে সাবধান করে দিত। সকলে সেটাও মনে করত পাগলামী।

যামিনীরঞ্জনের দুই ভগ্নী কনকলতা ও হেমলতা। পিতৃমাতৃহীন বিবাহযোগ্যা নাতনীদের বিবাহের উদ্যোগ করলেন বরদাসুন্দরী। তারাচরণ ভাগ্নীদের অত্যন্ত স্নেহ করত। সে দেখলো যেন একজনের অকাল বৈধব্যযোগ। অপরের অকাল মৃত্যুযোগ। তাই এই কচিকোমল প্রাণদুটি সংসারের তাপানলে দগ্ধ যাতে না হয়, তার জন্য তারাচরণের দুশ্চিন্তার সীমা নেই! তারাচরণ প্রচণ্ড আপত্তি জানাল, কিন্তু সে আপত্তি টিকল না। তখন “তারা পাগলা” শুরু করল উৎপাত, সারা ঘরে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দিতে লাগল। বরদাসুন্দরী গালাগালি করলে বলল, “তাহলে বিয়ে বন্ধ কর”। কিন্তু কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, সুতরাং বিয়ের সমস্ত আয়োজন শুরু হল। তারাচরণের উৎপাত বেড়ে গেল। অগত্যা পাগলাকে ধরে হাতে পায়ে বেঁধে একটা ঘরে নিয়ে আটকে রেখে দিল। তারাচরণ বাধা দিতে গেলে বল-প্রয়োগ এবং মুষ্ট্যাঘাতও হল। তারাচরণ খুব কান্নাকাটি করল; তারপর করুণ সুরে শুধু বলল, “তোরা কি আমাকে পাগল সাব্যস্ত করলি?"

‘তারা পাগলা’র কথায় সকলে বিদ্রপ করতে লাগল। তারাচরণ বলল, “বুঝিবি, বুঝিবি, আমার কথা পরে বুঝিবি।” কনকলতা বিবাহের পর বেশিদিন স্বামীর ঘর করতে পারে নি। একটি মাত্র কন্যার জন্মের পর সে বিধবা হয়। আর হেমলতাও বিবাহের পর একটি মাত্র পুত্রের জন্মের পর মারা যায়। দীর্ঘদিন পরে সকলে অনুধাবন করতে পারে যে, “তারা পাগলা” বাজে কথা বলেনি।

বিধবা হয়ে কনকলতা পিতৃগৃহে বসবাস করে এবং যতকাল তারাচরণ ধলঘাটে ছিলেন ততকাল তারাচরণের সেবায় আত্মনিয়োগ করে। তারাচরণ ধলঘাটে একমাত্র কনকলতার হাতের রান্না খেতেন, আর কারো হাতে খেতেন না। কনকলতা যাতে মনের দুঃখে মুহ্যমান হয়ে না পড়ে, তার জন্য তাকে সর্বক্ষণ কাজে নিযুক্ত রাখতেন। পরে ভক্ত মহিলাদের দেখাশোনার ভার সম্পূর্ণ কনকলতার উপর ছিল। কনকও অক্লান্তভাবে অম্লান বদনে সমস্ত কার্য্য সুসম্পন্ন করত।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৮)

-------------------------------------------

‘তারা পাগলা’র সঙ্গে কিন্তু গ্রামের বালকবালিকাদের খুব সৌহার্দ্দ্য জমে উঠল। বালকেরা তারা পাগলার উপর দৌরাত্ম্য করে, পাগলা তাদের ধমক দেয়, বলে, “যা, যা, দুষ্টামি কেন করিস? তুই পাশ করেছিস, অত নম্বর পেয়েছিস, তুই ফেল করেছিস, যা পড় গে।”

বালকদের ঔৎসুক্য বেড়ে গেল। সকলে এসে ঘিরে ধরল তারা পাগলাকে, জিজ্ঞেস করতে লাগল কোলাহল করে, কে কে পাশ করেছে। তারা পাগলা প্রত্যেককে বলতে লাগল, কে পাশ করেছে, কত নম্বর পেয়েছে। যে ফেল করেছে তাকে বলতে লাগল, “যা, যা, পড়াশুনা করগে- তুই এত নম্বর পেয়েছিস, ফেল করেছিস।”

পরীক্ষার ফল যখন বেরুল, বালকেরা অবাক হয়ে দেখল, তারা পাগলা যাকে যা বলেছে, ঠিক তাই হয়েছে। এমনকি নম্বর পর্যন্তÍ মিলে গেছে। তারা বিস্মিত হল এবং বারবার তারা পাগলাকে ঘিরে ধরতে লাগল। কিন্ত ছেলেদের অভিভাবকগণ তখনও পর্যন্ত এ ঘটনাকে তেমন আমল দিল না।

কিশোর বালকেরা তারাচরণের চারদিকে জটলা করে, তারাচরণও তাদের সঙ্গে ক্রীড়ামোদে মেতে ওঠে। একবার ধলঘাট স্কুলের পূর্বদিকে ‘কানুর দীঘির’ পারে ছেলেরা খেলছিল। তারাচরণ সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল, ওয়াদ্দাদারদের বাড়ীর একটা কিশোর তাঁকে দেখে বলে উঠল, “এই তারা পাগলা”!

তারা পাগলা ঘুরে দাঁড়াল এবং কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে কী ভাবল। তারপর বলল, “অ মণি, বাড়ী যা, বাড়ী যা শীগগির -তোর বাবা ত মারা গেছে তাকে নিয়ে আসছে।”

ছেলেটা আমলই দিল না পাগলার কথা। কিন্তু বাড়ী ফিরে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল, শুনল শহর থেকে তার বাবার মৃতদেহ নিয়ে আসছে। সে সকলকে তারা পাগলার কথা জানাল।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-৯)

-------------------------------------------

আর একিদনের কথা। তারা পাগলা দুপুরে স্নানের পর বুড়াকালীর মন্দিরে যাচ্ছে। পথের পাশে এক পুষ্করিণীর ঘাটে একটি বধূ কলসী ভরে জল নিয়ে চাল ধুচ্ছিল। বধূটির দিকে তাকিয়ে তারা পাগলা বলল, “মাগো, আর চাল ধুচ্ছ কেন? তুমি ত বিধবা হয়েছ।”

বধূটি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হল। পাগলের পাগলামির একটা সীমা আছে, তা বলে যা তা বলতে হবে? পাগলামি বার করে দিতে হবে এই সঙ্কল্গ নিয়ে সে বাড়ী ফিরল। কিছুক্ষণ পরে টেলিগ্রাম এল, তার স্বামী ব্রহ্মদেশে চাকরি করত, সেখানে সে মারা গেছে।

সারা গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেল। গ্রামবাসীদের ধারণা বদ্ধমূল হল যে, তারা পাগলা ভাল গুনতে পারে। তখনও পর্যন্ত কারো ধারণায় এমনকি কল্পলায় এল না যে তারা পাগলা সাধারণ মানুষ নন। গ্রামের লোক তারা পাগলার কাছে ভবিষ্যত জানতে এসে ভিড় করতে লাগল।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-১০)

-------------------------------------------

কিন্তু আগুন ছাই চাপা হয়ে বেশীদিন থাকে না। ১৩২৩ সালের কথা। বুড়াকালীর মন্দিরে মায়ের পদতলে কে রোজ রাত্রিবেলা পূজা করে যায় টাটকা জবাফুল দিয়ে। রোজ সন্ধ্যারতির পরে পূজারী ঠাকুর প্রতিমার পদতল পরিষ্কার করে বাসি ফুল ফেলে দিয়ে যান, কিন্তু কে এই লোক যে রোজ রাত্রে জবাফুল দিয়ে পূজা করে যায়? মন্দির তালাবদ্ধ থাকে, অথচ ভিতরে প্রবেশ করে কী করে? গ্রামে একথা প্রচার হয়ে পড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। গ্রাম্যযুবকেরা কয়েকজন মিলে ঠিক করল রাত্রিবেলা কালীমন্দিরে পাহারা দেবে।

অমাবস্যার রাত্রি। বুড়াকালীমন্দিরের সম্মুখস্থ বট ও অশ্বত্থ গাছের বিরাট বিরাট শাখার উপর বসে যুবকেরা পাহারা দিতে লাগল। গভীর রাত্রি, ঝি ঝি ডাকছে একটানা সুরে। দূরে শিয়ালের ডাক- আর তার উত্তরে গ্রামের কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। সামান্য পাতা নড়লেও শব্দ পাওয়া যায়। নীরব নিঝুম চারিদিক। হারগেজী নদীর ওপারে মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে আলেয়ার আলো। এমন সময় দেখা গেল অন্ধকারে কে একজন এগিয়ে আসছে, শুধু তাঁর পরিহিত বস্ত্রের শুভ্রতা থেকে বোঝা যাচ্ছে তাঁর আগমনের কথা।

যে আসছিল সে সোজা কালীমন্দিরে গিয়ে প্রবেশ করল। বহুক্ষণ কেটে গেল, শুধু মন্দিরের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে একটা গুঞ্জন- গুনগুন করে কথা বলার শব্দ।

ভোরের আকাশে শুকতারা জ্বলছে দপদপ করে। হিমেল হাওয়ায় বট অশ্বত্থের পাতা ঝিরঝির করে নড়ছে, টুপটুপ করে শিশির বিন্দু ঝরে পড়ছে। পাহারাদারদের চোখ তন্দ্রায় জড়িয়ে এল। হঠাৎ চোখ খুলে একজন দেখল-মন্দিরে যে লোক ঢুকেছিল সে বেরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে নেমে এলো পাহারাদারেরা, অবাক বিম্ময়ে দেখল যে ‘তারা পাগলা’ই সেই লোক। পাহারাদারেরা তারাচরণের চরণ চেপে ধরল, বলল, “তোমাকে ত বুঝিনি এতদিন, আমাদের সব অপরাধ ক্ষমা কোরো।”

তারা পাগলা বলল, “তাতে আর কি? আমি ত সামান্য, নগণ্য মানুষ, আমি ত আর সাধু নই!”

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-১১)

-------------------------------------------

তারপরে আর বাঁধ রাখা গেল না। তডিৎবেগে একথা চতুর্দিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল। বন্যার মত নরনারী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

চৌধুরীদের ঠাকুর মণ্ডপে বসে ‘তারা পাগলা’ তাঁর সেই উদাত্ত গভীর স্বরে দুহাত তুলে সকলকে আহ্বান জানাল- “ওরে আয়,আয়, কে কোথায় আছিস, আয়। তোদের জন্য আমি বসে আছি।” ‘তারা পাগলা’ ‘তারাচরণ সাধু’ বলে অভিহিত হল।

ধলখাট গ্রামে মেলা বসে গেল। কর্ণফুলীর ওপার থেকেও নরনারী সাধুর দর্শনের জন্য আসতে লাগল। চট্টগ্রাম শহর থেকে বড় বড় রাজকর্মচারীও ধলঘাট গ্রামে সাধুর চরণধূলি পাবার জন্য আসতে লাগলেন। যারা আসেন, সকলকেই প্রসাদ দেবার জন্য সাধুর নির্দেশ; কেউ প্রসাদ না নিয়ে গেলে তারাচরণ মনোকষ্ট পেতেন। যামিনীরঞ্জনের বাড়ীতে তাদের অভ্যর্থনার ও প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা হল। ভোর সকাল থেকে উনানে যে আগুন জ্বলত গভীর রাত্রি পর্য্যন্তÍ উনানের সে আগুন নিভত না; এবং প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত প্রসাদ বিতরণ চলত। গ্রামের যুবকেরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজে লেগে গেল। ধলঘাট থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে মীরেশ্বরীর পুলিন নামে এক যুবক এই সেবাকার্যে কিছুদিন রান্নার কাজ করেছিল। পরে সন্ন্যাস নিয়ে পুলিন, প্রজ্ঞানন্দ নাম গ্রহণ করে।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ -এর দিব্যোম্মাদ (পর্ব-১২)

-------------------------------------------

এই জনস্ত্রোতের মধ্যে আর্ত্তজন কে কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে ডেকে সাধু তারাচরণ বলতে লাগল। মুমূর্ষু রোগী, আর্ত্ত বিপন্ন প্রত্যেকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দিতে লাগল তারাচরণ। অন্যায় ও দুষ্কৃতকারী যদি দোষ স্বীকার করত, তাহলে তারাচরণ তার মাথা মুড়িয়ে দিয়ে তার পাপের ক্ষালন করে দিত। সর্বক্ষণ একজন নাপিত মাথা মুড়ানোর জন্য বসে থাকত। মাথা মুড়ান হলে স্নান করিয়ে তাকে বুড়াকালীর মন্দিরে সঙ্গে করে নিয়ে যেত, সেখানে মায়ের পদতলে ব্যাকুল কান্নায় তার জন্য প্রার্থনা করত। প্রার্থনার পরে বলত, “মায়ের ইচ্ছায় তোমার উদ্দেশ্য সফল হবে। আর অন্যায় কোরো না।”

এখন চারিদিক থেকে লোক শুধু ধলঘাটের দিকে দৌড়াচ্ছে, অলির দল যেন মধুর সন্ধান পেয়েছে। সকলের জন্য সাধুর অবারিত দ্বার, শরণাগতের জন্য তাঁর অযাচিত আশীর্র্ব্বাদ। বদলে সাধু কিছু চায় না, দিতে গেলে বরং ক্ষেপে ওঠে।

রামশরণ নামে একজন হিন্দুস্থানী- চট্টগ্রাম শহরে তার বড় খাবারে দোকান। চোখের অসুখে ভুগছে। বহু ডাক্তার কবিরাজ ব্যর্থ হয়ে গেছে, তার দৃষ্টিশক্তি ক্রমেই নিভে আসছে। প্রায় অন্ধ। চোখের আলো হারানোর অর্থ জীবনের মূল্য হারানো। সে দুশ্চিন্তায় পাগল হবার জোগাড়। বহু অর্থ ব্যয় করেও কোন ফল হল না। হঠাৎ সে সাধু তারাচরণের কথা শুনতে পেল, এ সাধুর কাছে গিয়ে কেউ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে না। সে ছুটে গেল ধলঘাট গ্রামে। তাকে দেখেই সাধু ক্ষেপে উঠলেন। বললেন, “জুয়াচুরি করে নাবালকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছ তুমি। তুমি অন্ধ হবে না ত হবে কে?”

রামশরণ সাধুর চরণে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করল। অনুতপ্ত হৃদয়ে সে নাবালকের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। সাধু তারাচরণ তাকে বুড়াকালীর মন্দিরে উপাসনার সময় যেতে বললেন। মায়ের চরণতলে পড়ে সাধুর রোদন আরতি সমাপ্ত হবার পর রামশরণকে পূজার আশীর্র্ব্বাদ ও চরণামৃত দিলেন। এইরূপ তিনদিন চরণামৃত চোখে লাগানোর পর অন্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-১)

----------------------------------

লোকে বলে তারাচরণ বড় সাধু হয়েছে, হাজার হাজার লোক তাঁর কৃপা লাভ করছে। পুত্র-গৌরবে অমলার বুক ভরে উঠেছে।

তারাচরণের পিতা রসিক দত্ত মহাশয় ইতিমধ্যে পরলোক গমন করেছেন। পিতার মৃত্যু সংবাদে তারাচরণ ‘কাছা’ পরেন নি। অমলা শোকে মুহ্যমান হলেও মনে তাঁর অপরিমিত শক্তি। বিধবা হবার পর অমলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অমলার মা যখন কাঁদছিলেন, অমলা বলেছিলেন, “আমি চিরকাল সধবা থাকব নাকি? একি হতে পারে?” এই ঘটনার উল্লেখ করে সাধুবাবা তাঁর মায়ের সম্বন্ধে বলতেন, “অম মা রে মা, আমার মা যেমন তেমন ছিলেন না। এই রকম কঠোর ছিলেন।”

অমলার অমলিন হৃদয়। সংসারের প্রতিও কেমন একটা নিরাসক্ত ভাব! মন সর্বক্ষণ সরল ধর্মবিশ্বাসে ভরপুর! বাড়ীতে একবার বহু অতিথির মধ্যে গেরুয়াধারী একজন নিম্নশ্রেণীর লোক উপস্থিত ছিল। গৃহের রীতি অনুযায়ী অতিথিদের অন্নাদি পরিবেশন করা হচ্ছিল, কিন্তু উক্ত গেরুয়াধারী সকলের সঙ্গে বসে খাবে না বলায় অমলা নিজে তার জন্য পৃথক রান্না করে অতিথির পরিচর্যা করলেন। অধিকন্তু গেরুয়াধারীর উচ্ছিষ্ট অন্নও প্রসাদ বলে গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। গেরুয়াধারী যে প্রকৃত সাধু নয়, তা অতিকষ্টে বুঝিয়ে তবে তাঁকে নিবৃত্ত করান হয়।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-২)

----------------------------------

অমলার অমলিন হৃদয়। সংসারের প্রতিও কেমন একটা নিরাসক্ত ভাব! মন সর্বক্ষণ সরল ধর্মবিশ্বাসে ভরপুর! বাড়ীতে একবার বহু অতিথির মধ্যে গেরুয়াধারী একজন নিম্নশ্রেণীর লোক উপস্থিত ছিল। গৃহের রীতি অনুযায়ী অতিথিদের অন্নাদি পরিবেশন করা হচ্ছিল, কিন্তু উক্ত গেরুয়াধারী সকলের সঙ্গে বসে খাবে না বলায় অমলা নিজে তার জন্য পৃথক রান্না করে অতিথির পরিচর্যা করলেন। অধিকন্তু গেরুয়াধারীর উচ্ছিষ্ট অন্নও প্রসাদ বলে গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। গেরুয়াধারী যে প্রকৃত সাধু নয়, তা অতিকষ্টে বুঝিয়ে তবে তাঁকে নিবৃত্ত করান হয়।

তাঁর আদরের ‘তারা’ সাধু হয়ে কি রকম হল অমলার দেখতে বড় সাধ। ছেলেটাকে তো সংসারী করা গেল না, ছেলেমানুষ বৌ অরণ্যকুমারীর স্বামীসুখ ঘটল না অদৃষ্টে। অমলার দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে।

কিন্তু অরণ্যকুমারী খুব কাজের মেয়ে, দিন রাত কাজ করে নিঃশব্দে। নিজের আহার নিদ্রার দিকেও ভ্রুক্ষেপ নাই। অহরহ সংসারের টুকটাক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সংসারের সকলের সেবা শশ্রুষায় তাঁর ক্লান্তি নেই, তাতেই সে নিজের অস্তিত্বের কথাও ভুলে যায়। বিবাহিত জীবনের স্বাদ সে পায় নি, তার জন্য তাঁর মনে কোন প্রকার গ্নানিও নেই। স্বামী সাধন ভজন নিয়ে থাকে, সাংসারিক কোন কাজকর্ম করে না, সুতরাং তাঁর কাছে সাংসারিক কোন দাবী দাওয়া করে কী হবে? তাতে তাঁর সাধনার শুধু বিঘœই হবে। সে সহধর্মিণী, স্বামীর ধর্ম-পথে সে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে চায় না।

সাধু বলে পরিচিত হবার পূর্বে তারাচরণ যখন মাঝে মাঝে গুজরা আসত, তখন স্বামীর সম্মুখে অন্নের থালা পরিবেশন করত অরণ্য। নীরবে নতমস্তকে তারাচরণ খেয়ে গেছে। সারা দিন রাতের মধ্যে শুধু দুবার খাবার সময়েই স্বামীর সাক্ষাৎ মিলত। অরণ্য ঘোমটার আড়ালে চকিতে চেয়ে দেখত, স্বামীর তপস্যাকৃশ দেহের দিকে। লোকে মন্দ বলছে, ‘পাগলা’ বলে অবজ্ঞা করছে, তাতেও ভ্রুক্ষেপ নাই, নিজের সাধনার পথে এগিয়ে চলেছে। স্ত্রীলোকের পায়ের দিকে ছাড়া মুখের দিকে তাকায় না। খেয়ে আবার সেগুলো গলায় হাত দিয়ে বমি করে ফেলছে। রাত্রিবেলা ঘুম একটুও নেই। এই শরীর চলবে কী করে- কতদিন চলতে পারে? অরণ্যের বুকের ভিতর এই ‘পাগল’ স্বামীর জন্য একটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠে আবার একটা অজানা আনন্দেও তার মন ভরপুর হয়ে ওঠে। সে আনমনা হয়ে নিজের কাজে যায়।

এখন স্বামী খুব বড় সাধু হয়েছে- দেশজোড়া তাঁর নাম। তাঁর চরণের ধূলি পাবার জন্য কত বড় বড় লোক ছুটে আসছে। স্বামীগর্বে তাঁর বুক ফুলে ওঠে। সে কী চরণস্পর্শ পাবে না, দর্শনও পাবে না, সে কী চিরবঞ্চিতা থাকবে।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৩)

------------------------------------

অমলা তাঁর তৃতীয় পুত্র মহেন্দ্রকে পাঠালেন ধলঘাট গ্রামে ‘তারা’কে আনার জন্য। তারাচরণের দ্বিতীয় ভ্রাতা কামিনীকুমার ডিব্রুগড় সরকারী হাসপাতালের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার, সপরিবারে তিনি আসামে ডিব্রুগড়ে বাস করেন।

মাহেন্দ্রকুমার আজীবন নিষ্ঠাবান, ব্রহ্মচারী, তাঁর সরল মধুর ব্যবহার আর সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখ অপরিচিতকেও মুহূর্তে আপন করে নিত। মহেন্দ্রকুমার ধলঘাটে এসে তারাচরণকে মায়ের অভিপ্রায় জানালেন। তারাচরণ দুদিন পরে গভীর রাত্রে লোকের ভিড় এড়িয়ে চললেন মাতৃ-দর্শনে গুজরায়। সঙ্গে গেলেন কয়েকজন ভক্ত তার মধ্যে আছেন রাজকুমার দত্ত নামে এক বিশিষ্ট ভক্ত। রাজকুমারবাবু তখনও মুন্সেফ হন নি। তারাচরণ তাঁকে দেখামাত্র বলেছিলেন যে তিনি মুন্সেফ হবেন। সরকার-নির্দেশিত বয়স অতিক্রম করেছিলেন বলে রাজকুমারবাবু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য রাজকুমারবাবু পরবর্ত্তী জীবনে সাবজজ্ হয়ে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

গুজরা যাবার সময় তারাচরণ চলেছেন দ্রুত এগিয়ে। পশ্চাতে হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে মহেন্দ্রকুমার এবং ভক্তদল। বুড়াকালীর মন্দিরে গিয়ে দাঁড়ালেন, মন্দির তালাবন্ধ। পুরোহিতের বাড়ীতে চাবির জন্য লোক পাঠানো হল, কিন্তু চাবি পাওয়া গেল না। তারাচরণ হাত দিয়ে তালা স্পর্শ করলেন, তালা খুলে গেল। মন্দিরে প্রবেশ করে মায়ের যেন অনুমতি নিলেন তারাচরণ। অস্পষ্ট কথাবার্তার গুঞ্জন শেষ হলে তিনি মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন এবং পুনরায় হস্তম্পর্শে তালা বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললেন।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৪)

----------------------------------------

শীতের রাত্রি, হিমেল হাওয়া বইছে। পদব্রজে রাত প্রায় দুটার সময় ভক্তগণসহ কর্ণফুলীর তীরে ‘খেলার ঘাটে’ এসে দাঁড়ালেন তারাচরণ। অস্পষ্ট কুয়াসায় বিরাট নদীর বুকে কিছু দেখা যায় না, শুধু বড় বড় ঢেউয়ের কুলের উপর আছাড় খেয়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনাও যায় না।

এত অধিক রাত্রে নদী পার হওয়ার সমস্যা নিয়ে ভক্তগণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু সাধু আপন মনে নদীতীরের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন, দু'টি হাত সম্মুখদিকে আঙ্গুলে আঙ্গুলে জড়িয়ে নিবদ্ধ। হু হু করে জোলা হাওয়ায় গায়ের পাতলা চাদর উড়িয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ নদীর ভিতর থেকে মাঝির ভারি গলা শোনা গেল- “বাবুরা পার হইব্যান? আহেন, আহেন।”

ভক্তগণ আনন্দে নেচে উঠলেন, যাঁর সমস্যা তিনিই সমাধান করেছেন। মাঝি তার সাম্পানে করে সকলকে নদীর ওপারে পৌঁছে দিল। বিনিময়ে ভাড়ার অতিরিক্ত এক পয়সাও নিল না।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৫)

-----------------------------------------

জননী অমলা ‘তারা’ কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মুহূর্তের মধ্যে সারা গ্রামের লোক ছুটে এল দত্তবাড়ী, ‘তারা পাগলা’ সাধু হয়েছে এ সকলে চোখে দেখতে চায়। তারাচরণ ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসেছে। বাড়ীর সম্মুখে বিরাট অঙ্গন লোকে লোকারণ্য। রাস্তাঘাটেও লোক ধরে না। তারাচরণ সমাগত লোকদের মধ্যে অন্যায়কারীর নাম ধরে ডেকে তার পাপ কাহিনী বলতে লাগল। যে অন্যায় স্বীকার করতে লাগল, তার মাথা মুড়িয়ে আশীর্বাদ দিতে লাগল। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসে মাতব্বরের ভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে গুরুতর অপরাধী। তারাচরণ তারও মাথা মুড়িয়ে দিল। যারা পরীক্ষা করতে এসেছিল, তারাচরণের এই অন্তর্দৃষ্টির ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হল। অনেকে তাঁর করুণা ভিক্ষা করে, আশ্রয় চাইল। তারা বুঝলো যে সাধু তাঁর দুই চক্ষুর উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ভূত ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পারেন।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৬)

-------------------------------------------

ঠাকুরঘরে জয়কালীর মৃন্ময় ছোট মূর্তি, তার পাশে নারায়ণ শিলা, অপর পার্শ্বে বুদ্ধের একটি ছোট মূর্তি। তারাচরণ মধ্যাহ্নে ঠাকুরঘরে ব্যাকুল রোদন শুরু করলেন। বহুক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁর কান্না থামে না, অশ্রুজলে মেদিনী সিক্ত হয়ে গেল। উপস্থিত নরনারী এই অপূর্ব রোদন স্তব্ধ হৃদয়ে শুনতে লাগল। সারা বুকের রক্ত নিঙড়ে বোধ হয় এই বুকফাটা কান্না। মাথা কূটে কূটে রক্ত বেরোয়, সারা দেহে স্বেদ ঝরছে এই শীতের দিনেও, থরথর করে কাঁপছে সর্বদেহ, গায়ের রোম পর্য্যন্ত খাড়া হয়ে উঠছে। অশ্রু, স্বেদ, কম্প, রোমাঞ্চ প্রভৃতি দিব্যভাব দর্শন করে সকলে বিস্ময়ে বিমূঢ়। কারো মুখে কথা জোগায় না।

প্রায় দুঘণ্টার পর রোদন আরতি থামল। চোখের জলে সমস্ত মাটি ভিজে গেছে, পিচকারীর মত দু’নয়নের ধারা মাটির মেঝেতে দুটি গর্তের সৃষ্টি করেছে। সাধু সকলকে পূজার নির্ম্মাল্য ও চরণামৃত দিলেন। যারা দুরারোগ্য রোগের শান্তি কামনা করে এসেছিল তাদের কাউকে চরণামৃত, কাউকে ডাব, পেঁপে ইত্যাদি স্পর্শ করে দিলেন। কাউকে আবার শুধু বিল্বপত্র ছুঁয়ে দিলেন।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৭)

-------------------------------------------

প্রায় দুঘণ্টার পর রোদন আরতি থামল। চোখের জলে সমস্ত মাটি ভিজে গেছে, পিচকারীর মত দু’নয়নের ধারা মাটির মেঝেতে দুটি গর্তের সৃষ্টি করেছে। সাধু সকলকে পূজার নির্ম্মাল্য ও চরণামৃত দিলেন। যারা দুরারোগ্য রোগের শান্তি কামনা করে এসেছিল তাদের কাউকে চরণামৃত, কাউকে ডাব, পেঁপে ইত্যাদি স্পর্শ করে দিলেন। কাউকে আবার শুধু বিল্বপত্র ছুঁয়ে দিলেন।

সমাগত নরনারী সকলকে প্রসাদ নিয়ে যেতে হতো, নইলে সাধু মনোকষ্ট পান। রান্নার কাজে লাগলেন অরণ্যকুমারী, তাঁকে সহায়তা করতেন তাঁর এক জ্যাঠতুতো দেওরের স্ত্রী কুমুদিনী। এই কুমুদিনীর স্বামীও বিবাহের পর সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যস গ্রহণ করেন, নাম হয় স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ। তাই এই জায়ের প্রতি অরণ্যের স্নেহমাখা সহানুভূতি ছিল, কাজেকর্মে এই জা তাঁর সঙ্গে লেগে যেতেন। দুজনে মিলে অন্নযজ্ঞের প্রস্তুতিতে মেতে উঠলেন। রান্নার পরও অরণ্যের বিশ্রাম ছিল না, পরদিনের রান্নার জন্য গভীর রাত্রি পর্য্যন্ত বসে বসে তরকারি কুটতেন। ঘরের সমস্ত বিছানা, এমনকি নিজের বিছানাও সমাগত ভক্তদের জন্য দান করে শুধুমাত্র আঁচলখানি মাটিতে পেতে বাকী রাতটুকু কাটিয়ে দিতেন।

অরণ্যকুমারী ‘তারা পাগলা’র বৌ, তখন সবেমাত্র সাধুর বৌ হিসাবে গণ্য হতে আরম্ভ করেছেন। সুতরাং বাড়ীর বৌ খেল কি ঘুমাল তার দিকে অত নজর দেয় কে?

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই অন্নযজ্ঞের সামর্থ্য কোথায়? অমলা অরণ্যের উপর সংসার ছেড়ে দিয়েছেন, তাই তিনি মাথা ঘামান না। কিস্তু অরণ্য মনে মনে চঞ্চল হয়ে পড়েন।

 

শ্রীশ্রীমৎ তারাচরণ গুজরায় মাতৃসন্দর্শনে(পর্ব-৮)

-------------------------------------------

তারাচরণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা উপেন্দ্রনাথ সাধারণ চাকরী করতেন। যে সামান্য টাকা তিনি পাঠান, তাতে কদিন চলবে? সে টাকাও শেষ হয়ে এসেছে। তবে তিনি নিশ্চিত জানেন যে সাধুর কাজ কোনমতে আটকায় না। শেষ পর্যন্ত আটকালও না।

তারাচরণের দ্বিতীয় ভ্রাতা কামিনীকুমার তখন লুংলে পাহাড়ে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। তাঁর বড় ছেলে শৈলেনকে কুকুরে কামড়েছে, তার জন্য শিলং-এ গিয়ে পাস্তর চিকিৎসা করাতে হবে। সেই সময় শিলং ভিন্ন অন্য কোথাও ঐ ওষুধ পাওয়া যেত না।

কামিনীকুমার মনে মনে ভাবলেন, শিলং অনেক দূরের পথ, গ্রামের বাড়ীতে দুদিন থেকে তারপর ছেলেকে নিয়ে শিলং যাত্রা করবেন। তিনি গুজরার দিকে যাত্রা করলেন।

বাড়ীর কেউ জানে না যে কামিনীকুমার আসছেন, কারণ তিনি বাড়ীতে কোন চিঠিপত্র কিংবা সংবাদ দেন নি। তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে নৌকা করে আসছেন, নৌকা বড় গাখালির খালে এসে যখন পৌঁছাল, তখন তারাচরণ বাড়ীর একজন লোককে ডেকে বললেন, “যাও, যাও, কামিনী এসেছে। নৌকাঘাট থেকে তাকে নিয়ে এসো।"

 

শ্রীশ্রীবুড়াকালী মা ও তারাচরণ সাধু

-------------------------------------------

চট্টগ্রামের ধলঘাটের প্রসিদ্ধ বুড়াকালীর মন্দির। বুড়াকালী জাগ্রত দেবতা। মন্দিরের পিছনে হারগেজী নদী কুলকুল রবে বয়ে গেছে। পাশে শিবমন্দির; সম্মুখে বৃহৎ প্রাঙ্গণের দুপাশে দুটো প্রাচীন বট ও অশ্বত্থ-গাছ, শাখায় প্রশাখায় এ স্থানটিকে ছায়া-সুনিবিড় করে তুলেছে। দুপাশে দুটো পুষ্করিণীর পাড়ে ঘন জঙ্গল, দিনের বেলা শেয়াল ঘুরে বেড়ায়, সাপখোপের ভয় ত' আছেই।

মন্দিরও ভগ্নপ্রায়, মন্দিরের অভ্যন্তরে আলো নাই, ক্ষুদ্র বাতায়ন-পথে যেটুকু আলো আসে তাতে আলো আঁধারির খেলায় অস্পষ্টতা আরও বেড়ে ওঠে। এ অন্ধকার প্রচ্ছদপটে বুড়াকালীর মূর্তি প্রথম দর্শকের মনে ভীতির সঞ্চারই করবে।

প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে রাজারাম দত্ত স্বপ্ন দেখেন যে, কালী তাঁকে আদেশ দিচ্ছেন, এক নিমগাছের ভিতরে তিনি আবদ্ধ হয়ে আছেন, রাজারাম যেন তাঁকে বাহির করে প্রতিষ্ঠা করেন। সারা গ্রাম খুঁজে অবশেষে এক নাপিতের বাড়ীতে রাজারাম তাঁর স্বপ্ন-দৃষ্ট নিমগাছ দেখতে পেলেন। টাকা দিয়ে সেই নিমগাছ কিনে রাজারাম সেই গাছ থেকে কালীর মূর্তি খোদিত করান। তাঁর পিতৃ-মাতৃ-শ্মশানের উপর মন্দির নির্মাণ করে সেখানে দেবীর মূর্তি স্থাপিত করেন। কিন্তু ক্রমে নিম-কাঠ শুষ্ক হয়ে যায়, দেবী বৃদ্ধার মূর্তি পরিগ্রহ করেন। মুখ ভেঙ্গে কুঁচকে গিয়ে বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে যা দিয়ে দীর্ঘ লোল জিহ্বা চেপে ধরেছেন। বিশাল আয়ত চোখ দুটোও কোটর কেটে গিয়ে আরও বৃহৎ এবং আয়ত হয়েছে। কোমর ভেঙ্গে বেঁকে গেছে, বাহু-যুগল শীর্ণ হয়ে পড়েছে। কৃশ দুখানি চরণ নিয়ে শিবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। তখন থেকেই দেবী বুড়াকালী নামে অভিহিতা হলেন।

তারা পাগলা দুবেলা স্নানের পর বুড়াকালীর পূজা ও আরতির সময় দেবীর সম্মুখে ‘মা, মা’ রবে আকুল রোদন করতে থাকে। সে কান্নায় পাষাণও বুঝি গলে যায়। মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে কপাল কেটে রক্ত বাহির হয়, অশ্রুর ধারায় মেদিনী সিক্ত হয়ে ওঠে। এত অশ্রুজল ঝরত যে, মনে হত যেন কেউ একঘটি জল ঢেলে দিয়েছে। আর কোন মন্ত্র নাই, কোন অনুষ্ঠান নাই, শুধু ব্যাকুল বোবা কান্না মন্দিরের ভিতরে গুম্রে গুম্রে উঠত। আর কান্নার সাথে সাথে চলত তাঁর রোদন-সঙ্গীত-

ও মা, মা, মা, মা, মা, মা, মা ভবের জননী!

অশ্রুজলে ধোয়াইব, কেশ দিয়ে মুছাইব চরণ দু’খানি।

মন্দিরের বৃদ্ধ পূজারী প্রথম প্রথম বিরক্ত হয়ে উঠতেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে ‘তারা পাগলা’ শুধু দুবেলা নিজের কান্না কেঁদে যায়, তাঁর পূজার কোনপ্রকার বিঘ্ন সম্পাদন করে না, তখন বৃদ্ধ পূজারীও সে কান্নার মধ্যে পূজা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। একদিন এরূপ কান্নার পর ‘তারা পাগলা’ ছুটে গিয়ে বুড়াকালীর চরণে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। কাষ্ঠ-নির্মিত চরণে মাথা ঠেকতেই তাঁর অনুভব হল যেন দেবীর চরণ নরম তুলতুল করছে। ব্যাকুল আগ্রহে অপর চরণ স্পর্শ করা মাত্র অনুভব করল সেই চরণখানিও নরম তুলতুল করছে। মাথা তুলে মুখের দিকে তাকাল সাধক, দেখল মায়ের ভুবন-ভুলানো হাসি। মায়ের সঙ্গে সাধক কথাবার্তা শুরু করল। তাঁর আনন্দ আর ধরে না। ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা! কালীমন্দিরের মালিকদের কয়েকজন ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। ব্রাহ্মণ ছাড়া কায়স্থ দেবমূর্তি স্পর্শ করলেই দেবতা অপবিত্র হয়ে যায়। সুতরাং পাগলের পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়া সমীচীন হবে না। তাই বিগ্রহ স্পর্শ না করার জন্য ‘তারা পাগলা’র উপর নির্দেশ দেওয়া হল। তারাচরণ উত্তর দিল, “কালীকে আমি সর্বত্র পাব। মন্দিরে যাবার আমার প্রয়োজন হবে না।” সকলে মনে করল, এটা উন্মাদের দম্ভোক্তি।

বুড়াকালীর মন্দিরে দুবেলা ব্যাকুল কান্নার মধ্যেও তারাচরণ শুনতে পেলেন, একই কথার পুনরাবৃত্তি, “তুই সত্য নিয়ে থাক”। তাই পরে দেখা যায়, তিনি সর্বত্র সত্য-ধর্মের প্রচার করে গেছেন, বলেছেন, “সত্যই ধর্ম। সকল ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে।” সকল ধর্মের লোককে তিনি কোল দিয়েছেন এবং শরণাগত ভক্তের জন্য নিজের দেহকে তিল তিল করে বিলিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “এ দেহকে হোম করে যাব, তাতেও যদি কারো উপকার হয়”। ভক্তের দুঃখ, ভক্তের সন্তাপ, তিনি তাঁর অমৃত পরশ বুলিয়ে দূর করে দিয়েছেন। ভক্তদের সকল জ্বালা, দেহের হোক মনের হোক, নিজে গ্রহণ করে তাদের শান্তি দিয়েছেন।

কিন্তু আগুন ছাই চাপা হয়ে বেশীদিন থাকে না। ১৩২৩ সালের কথা। বুড়াকালীর মন্দিরে মায়ের পদতলে কে রোজ রাত্রিবেলা পূজা করে যায় টাটকা জবাফুল দিয়ে। রোজ সন্ধ্যারতির পরে পূজারী ঠাকুর প্রতিমার পদতল পরিষ্কার করে বাসি ফুল ফেলে দিয়ে যান, কিন্তু কে এই লোক যে রোজ রাত্রে জবাফুল দিয়ে পূজা করে যায়? মন্দির তালাবন্ধ থাকে, অথচ ভিতরে প্রবেশ করে কী করে? গ্রামে একথা প্রচার হয়ে পড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। গ্রাম্য-যুবকেরা কয়েকজন মিলে ঠিক করল রাত্রিবেলা কালীমন্দিরে পাহারা দেবে।

অমাবস্যার রাত্রি। বুড়াকালীমন্দিরের সম্মুখস্থ বট ও অশ্বত্থ গাছের বিরাট বিরাট শাখার উপর বসে যুবকেরা পাহারা দিতে লাগল। গভীর রাত্রি, ঝি ঝি ডাকছে একটানা সুরে। দূরে শিয়ালের ডাক- আর তার উত্তরে গ্রামের কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। সামান্য পাতা নড়লেও শব্দ পাওয়া যায়। নীরব নিঝুম চারিদিক। হারগেজী নদীর ওপারে মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে আলেয়ার আলো। এমন সময় দেখা গেল অন্ধকারে কে একজন এগিয়ে আসছে, শুধু তাঁর পরিহিত বস্ত্রের শুভ্রতা থেকে বোঝা যাচ্ছে তাঁর আগমনের কথা।

যে আসছিল সে সোজা কালীমন্দিরে গিয়ে প্রবেশ করল। বহুক্ষণ কেটে গেল, শুধু মন্দিরের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে একটা গুঞ্জন- গুনগুন করে কথা বলার শব্দ।

ভোরের আকাশে শুকতারা জ্বলছে দপদপ করে। হিমেল হাওয়ায় বট অশ্বত্থের পাতা ঝিরঝির করে নড়ছে, টুপটুপ করে শিশির বিন্দু ঝরে পড়ছে। পাহারাদারদের চোখ তন্দ্রায় জড়িয়ে এল। হঠাৎ চোখ খুলে একজন দেখল-মন্দিরে যে লোক ঢুকেছিল সে বেরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে নেমে এলো পাহারাদারেরা, অবাক বিস্ময়ে দেখল যে ‘তারা পাগলা’ই সেই লোক। পাহারাদারেরা তারাচরণের চরণ চেপে ধরল, বলল, “তোমাকে ত বুঝিনি এতদিন, আমাদের সব অপরাধ ক্ষমা কোরো।”

তারা পাগলা বলল, “তাতে আর কি? আমি ত সামান্য, নগণ্য মানুষ, আমি ত আর সাধু নই!”

  • YouTube
bottom of page