স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ
Source: https://www.facebook.com/tripulinga.swami.chowdhury.p.k.roy/
ত্রৈলঙ্গস্বামী মাত্র ২০জন শিষ্যকে খুব যাচই বাছাই পূর্বক দীক্ষা প্রদান করেন। স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ সরস্বতী তাঁদের অন্যতম। স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ সরস্বতী ঢাকা শহরের স্বামীবাগের সুপ্রসিদ্ধ ‘ডায়লা বাবা’। ত্রিপুরলিঙ্গঁ সরস্বতীর তিন প্রখ্যাত শিষ্য ছিলেন- শ্রীমৎস্বামী নীলানন্দজি, স্বামী শঙ্করানন্দজি, ঢাকা স্বামীবাগের মহান্ত মহারাজ শ্রীমৎস্বামী নরেশানন্দ সরস্বতী। কথিত আছে যে স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ সরস্বতীর নামানুসারে ঢাকাস্থ ঐ এলাকার নামকরণ হয় স্বামীবাগ। স্বামীবাগে স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ সরস্বতী স্বহস্তে প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রম আছে যা স্বামীবাগ আশ্রম হিসাবে পরিচিত। স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ সরস্বতী উক্ত আশ্রমে কালী ও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দেহত্যাগের পর মন্দিরের পাশেই তাঁর সমাধি মন্দির রচনা করা হয়।পরবর্তিতে এই আশ্রমের অভ্যন্তরে ইস্কনমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভারতবর্ষের কন্যাকুঞ্জে জীবেশ্বর তেওয়ারী নামে এক প্রাজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ ভগবৎ পরায়ণ ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি একাধারে উচ্চ বংশোদ্ভব ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং সত্যনিষ্ঠ সাধক ছিলেন বলিয়া রাজা মহারাজাগণ পর্যন্ত তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান করিতেন। তাঁহারা পণ্ডিতজীর নিশ্চিন্ত স্বচ্ছন্দ ভরণপোষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া দিয়েছিলেন। উহা হইতে ক্রমে তাঁহার বাৎসরিক আয় প্রায় সাত লক্ষ টাকায় দাঁড়াইয়াছিল। তিনি একসময় তাঁর আসন্ন প্রসবা সহধর্মিনী শ্রীমতি হরপ্যায়ী দেবীকে নিয়ে কল্পবাস ও স্নান উপলক্ষে এলাহাবাদ প্রয়াগরাজ ত্রিবেনীতে আসেন। সেখানে পূর্ব পরিচিত এক মহাত্মার সাক্ষাৎ হয়, যাকে পণ্ডিতজী এক সময় কিছু দান করতে চাইলে মহাত্মা যথাসময়ে চেয়ে নেবেন বলেছিলেন। তারপর ১১৭৯ বাং (১৭৭২ইং) শ্রীশ্রীরামনবমী তিথিতে হরপ্যায়ী দেবী অতি সুশ্রীকান্তি ও দিব্য জ্যোতি সম্পন্ন এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। প্রয়াগ তীর্থে জন্মেছে বলে পণ্ডিতজী নাম রাখলেন প্রয়াগনারায়ণ ও জীবানন্দ এবং ত্রিবেনীতীর্থে জন্ম হওয়ায় মাতা বেণীমাধব বলে ডাকতেন। বেণীমাধবের জন্মের দিনই ঐ মহাত্মা আরও অন্য তিনজন মহাত্মা সহ সদ্যজাত বেণীমাধবকে দর্শনে আসেন এবং দর্শন শেষে পণ্ডিতজীকে বলেন “এই শিশুই আমার পূর্ব্বপ্রার্থিত অভিলষিত প্রিয় বস্তু। আমি এখন এই শিশুকে পাইবার জন্য প্রার্থনা করি এবং তুমি পূর্ব্বের অঙ্গীকার রক্ষার জন্য নিরাপত্তিতে এই মহাত্মাত্রয় সমক্ষে আমার হস্তে এই প্রিয়দর্শন দিব্য শিশুকে প্রদান করিয়া কৃতার্থ হও।" পণ্ডিতজী পুতুলের মত নবজাত কোমল শিশুকে পরিশ্রান্তা পুত্র-স্নেহ-বিমুগ্ধা জননীর ক্রোড় হইতে লইয়া মহাপুরুষের পদপ্রান্তে স্থাপন করেন।
উপনয়ন হওয়ার কিছু দিন পর সেই মহাত্মা এসে পণ্ডিতজীর নিকট বেণীমাধবকে প্রার্থনা করলেন। বেণীমাধবকে বললেন “বৎস অনেকদিন কাটিয়া গেল, সুতরাং এখন চল আমার সঙ্গে একবার বন্যভূমি ভ্রমণ করিবে।” বেণীমাধব মহাত্মার সঙ্গে যাইতে রাজী হয়ে গেলেন। জীবেশ্বর তেওয়ারী ও হরপ্যায়ী দেবীর কষ্ট হলেও পূর্ব প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী ছেলেকে দান করেন। তারপর বেণীমাধব সেই মহাত্মার সাথে গমন করেন।
একাদিক্রমে একাদশ বৎসর কাল পরে বেণীমাধবের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম সমাপ্তান্তে সেই মহাত্মা বেণীমাধবকে গৃহে নিয়ে আসলেন। তিনি পণ্ডিতজীকে বলেন, “বেণীমাধবকে আমি কিছুদিনের জন্য সংসারাশ্রমে রাখিতে চাই। ইহার ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম সমাপ্ত হইয়াছে। এখন বিবাহ দিয়া ইহাকে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করাইতে হইবে।” সাথে সাথে এও বললেন কিছুদিন পর তাকে এসে নিয়ে যাবেন।
এক বছর পর সেই মহাত্মার আদেশমত বেণীমাধবের পিতা একাদশ বর্ষীয়া শ্রীমতি গঙ্গাদেবীর সাথে বেণীমাধবের বিবাহ দেন। বিবাহ বন্ধনের পর সংসার আশ্রমে তাঁহার তিন বৎসর কাটিয়া গেল, চতুর্থ বৎসরে গঙ্গাদেবী দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন এক পুত্র প্রসব করিলেন। তারপর একরাতে বেণীমাধব স্বপ্নে দেখেন মহাত্মা তাঁর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “বৎস এখনও কি তুমি ভোগ বিলাসে তৃপ্ত হওনি, পুত্রের মুখ দেখে কি আরও মোহে পড়বে, এখনই চলে এসো, বৃথা সময় নষ্ট করো না।” তারপর একদিন তিনি গৃহত্যাগ করলেন এবং শ্রীগুরুর নিকট চলিয়া গেলেন। কিছুদিন পর মহাত্মা বেণীমাধবকে নিয়ে তীর্থ পর্য্যটনে বের হলেন।
মহাত্মা বেণীমাধবকে নিয়ে গঙ্গা তীরে বিঠৌর নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে মহাত্মাজী তাঁর দেহ রাখার পূর্বে বললেন, “প্রথমে রামেশ্বর ক্ষেত্রে তোমার সাথে এক মহাত্মার সাক্ষাৎ হবে পরে হিমালয় প্রদেশে এক মহাপুরুষের সাক্ষাৎ হবে এবং তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান লাভ করে তোমার জীবনের বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হবে”। প্রায় ছয় মাস পর রামেশ্বরে তৈলঙ্গ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সেখানে তিনি বেণীমাধবকে দীক্ষিত করার জন্য অপেক্ষা করছেন। বেণীমাধব তৈলঙ্গ স্বামীজীর কথায় বুঝিলেন যে, শ্রীগুরু দেহরক্ষার পূর্বে বেণীমাধবের সকল ভার তাঁর উপর অর্পণ করেছেন। এও জানিলেন যে, যখন প্রয়াগে বেণীমাধবের জন্ম হয় তখন তিনিও অন্য মহাত্মা ও শ্রী গুরুজীর সহিত তাঁহাকে দেখিতে গিয়াছিলেন। দীক্ষার পর বেণীমাধবের নাম হয় ত্রিপুর্লিঙ্গ স্বামী। তিনি কিছুদিন পর তৈলঙ্গ স্বামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তীর্থ পর্য্যটনে বের হলেন এবং দীর্ঘপথ পর্য্যটনের পর জ্যোতিস্বামীর সাক্ষাৎ লাভ করলেন। জ্যোতিস্বামী হোমের ব্যবস্থা করলেন হোমান্তে ত্রিপুর্লিঙ্গ নিজের ভিতরে এক উদ্দীপ্ত তেজ অনুভব করিলেন ও সঙ্গে সঙ্গে যেন এক অভূতপূর্ব্ব মহানন্দ রসে মগ্ন হইয়া পড়িলেন। বহুক্ষণ এইভাবে কটিয়া গেলে পরে যখন তাঁহার হুঁস্ হইল তখন ভিতরে বাহিরে সর্ব্বত্রই তিনি এক আনন্দ রাজ্যের অস্তিত্ব অনুভব করিতে লাগিলেন।
অতঃপর তিনি জ্যোতিস্বামীর নিকট থেকে বিদায় নিয়ে হিমালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং দীর্ঘ পর্য্যটনের পর লামাস্বামীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। লামাস্বামী ত্রিপুর্লিঙ্গকে সস্নেহে তাঁর গুহায় নিয়ে যান। সেখানে মহানন্দে ত্রিপুর্লিঙ্গের প্রায় দেড় বৎসর কাটিয়া গেল। একদিন পাহাড়ের গায়ে এক বৃক্ষমূলে ত্রিপুর্লিঙ্গ বসিয়া আছেন, এক তম্ময়ভাবে তিনি মগ্ন- ক্রমে ক্রমে তাঁহার বাহ্যজ্ঞান লোপ পাইয়া গেল। এইভাবে কতক্ষণ ছিলেন উহা তাঁহার বোধ ছিল না কিন্তু যখন তাঁহার চেতনা ফিরিয়া আসিল তখন তিনি সমস্তই যেন মধুময় বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহার হৃদয়তন্ত্রী কাহার মধুর স্পর্শে যেন এক অতি সুমধুর তানে বাজিয়া উঠিল। তাঁহার মনের সকল রুদ্ধ দুয়ার খুলিয়া গেল- তাঁহার মনে হইতে লাগিল জগতটা যেন কি এক আনন্দে পূর্ণ ও চৈতন্যময়- সে আনন্দের শেষ নাই- সীমা নাই! বৃক্ষলতা, পাহাড়পর্ব্বত, আকাশ, বায়ু, জলস্থল সকলই যেন কি এক আনন্দে পূর্ণ - সে আনন্দের ছটায় চারিদিক উদ্ভাসিত। আত্মজ্ঞান লাভ করার পর ত্রিপুর্লিঙ্গ স্বামী জীব-জগতের কল্যাণ সাধন করবেন বলে লামাস্বামীকে জানালেন। লামাস্বামী প্রথমে নেপাল এবং পরে নিম্ন প্রদেশে গমনের কথা বললেন। তিনি ত্রিপুর্লিঙ্গকে অষ্টাঙ্গ যোগ ও বিভিন্ন যৌগিক প্রণালী শিখিয়ে দেন।
নানা তীর্থ পর্য্যটন করিয়া তিনি পুনরায় কলিকাতায় আসেন। এখানে তিনি কোন এক বেগম সাহেবার বিশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন এবং তাঁহার গৃহে কিছুকাল বাস করেন। তিনি জানিতে পারিলেন পূর্ব্ববঙ্গে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হইয়াছে এবং বহুলোক সেখানে অনাহারে মরিতেছে। ইহা শুনিয়া তাঁহার প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল। তিনি বেগম সাহেবার নিকট উপস্থিত হইয়া ঘটনা জানান। বেগম সাহেবা এই কাজে লক্ষাধিক টাকা দান করিবেন বলিয়া স্বামীজীর নিকট প্রতিশ্রুতি হইলেন। স্বামীজী আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া দিবা রাত্রি হাঁটিয়া প্রায় তিন দিন পর সিরাজগঞ্জে আসিয়া পৌঁছিলেন। তিনি বেগম সাহেবার প্রদত্ত টাকায় প্রপীড়িত লোকদিগকে সাহায্য করিতে লাগিলেন। স্থানে স্থানে সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করিয়া তথা হইতে জনসাধারণকে অন্নবস্ত্র দানের ব্যবস্থা করিলেন। পরে তিনি ময়মনসিংহ জেলায় আসিলেন। এখানেও তিনি স্থানে স্থানে বহু নিরন্ন ব্যক্তিকে সাহায্য করেন। এইভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে এক সময় তিনি পোড়াবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হ’ন। অবশেষে স্বামীজী ঢাকায় আসিয়া উপস্থিত হ’ন। এই স্থানটি তাঁহার পছন্দ হইলেও তিনি কয়েকদিন মাত্র এখানে থাকিয়া সমুদ্রগর্ভে অবস্থিত আদিনাথ টাপু ও চন্দ্রনাথ সীতাকু- তীর্থ দর্শনে যান। চন্দ্রনাথ প্রভৃতি তীর্থ দর্শন করিয়া পুনরায় তিনি ঢাকা হইয়া ময়মনসিংহ গমন করেন। ময়মনসিংহ হইতে তিনি পুনরায় কলিকাতায় গিয়া বেগম সাহেবার সহিত সাক্ষাৎ করনে।
বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র পর্য্যটন করে ত্রিপুর্লিঙ্গ কাশীধামে যান। সেখানে তৈলঙ্গ স্বামীজীর পুনরায় সাক্ষৎ লাভ করেন। তৈলঙ্গ স্বামীজী ত্রিপুর্লিঙ্গকে কিছুদিন তথায় থাকিতে বলিলেন। শ্রীগুরুর নিকট বাস করিবার অনুমতি পাইয়া তিনি পরম আনন্দিত হইলেন। ত্রিপুর্লিঙ্গ এক বৎসরের উপর শ্রীগুরুর নিকট মহানন্দে কাশীধামে বাস করেন। গুরুর নির্দেশানুসারে তিনি মানব কল্যাণে কাশীধাম পরিত্যাগ করিয়া বহুদেশ ঘুরিয়া তিনি ঢাকায় উপস্থিত হ’ন। তিনি কিছুকাল ঢাকার সন্নিকটে বনঙ্গলপূর্ণ বেগুণবাড়ী নামক এক নির্জ্জন গ্রামে এক প্রাচীন শিমূল বৃক্ষমূলে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আত্মগোপন করিয়া থাকেন। ঢাকার স্বনামধন্য নবাব খাজে আবদুল গণি মিঞা সাহেব বাহাদুর একদিন শিকারের অন্বেষণে সেখানে গিয়া জঙ্গল মধ্যে এই দিব্য শান্ত তেজঃপুঞ্জ সন্ন্যাসীকে দেখিতে পাইলেন। নবাব বাহাদুরের বিশেষ অনুরোধে স্বামীজী নবাব সাহেবের ঢাকার কুঠিতে গিয়া আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। স্বামীজী ঢাকা নগরীর অদূরবর্ত্তী কুরমিটোলার জঙ্গলে কামালশাহ্ ফকীর সাহেবের নির্জ্জন মাজারে সাধনার জন্য স্থান নির্ব্বাচন করিলেন। পরে নবাব বাহাদুর তাঁহাকে উক্ত মাজার ত্যাগ করিয়া ঢাকায় আসিতে একান্ত অনুরোধ করেন ও তাঁহার রমনাস্থিত বাগানবাড়ী ‘শাহ্বাগে’ একটী অতি প্রচীন বটবৃক্ষতলে স্বামীজীর থাকিবার বন্দোবস্ত করিয়া দেন। এই সময় স্বামীজী রঙ্গন শা ফকীর নামে ঢাকায় পরিচিত ছিলেন। নবাব বাহাদুর স্বয়ং রঙ্গন শা সাহেবের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ও অনুরক্ত দেখিয়া ক্রমে ক্রমে তাঁহার নিকট বহু জনসমাগম হইতে লাগিল। এইজন্য তিনি শাহ্বাগ ত্যাগ করিয়া গুপ্তভাবে নারায়ণগঞ্জ খানপুরে ও শীতললক্ষার অপর পারে বন্দর, রেকাববাজার প্রভৃতি পল্লীগ্রামে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করেন। ঘুরিয়া ফিরিয়া স্বামীজী পুনরায় ঢাকায় আসিলেন। এবার ঢাকায় আসিয়া রমনায় শাহ্বাগের নিকট এক বটগাছের তলায় তিনি আশ্রয় লইলেন। তখন রমনা ভীষণ জঙ্গলাবৃত ছিল। ঘটনাক্রমে ভক্তিনা নামে এক হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক সেখানে স্বামীজীকে দেখিতে পাইয়া তাঁহার ভোজন ভিক্ষার জন্য ফলমূলাদি আনিয়া দিতে আরম্ভ করে। পরে ভক্তিনার অনুরোধে তিনি তাহার বাবুবাজারের ডালের দোকানে আসিয়া আশ্রয় লইলেন।
ইতিমধ্যে ঢাকা শহরের এক বিখ্যাত জমিদার গোপ্রেন্দ্র মোহন বসাক ওরফে আকুবাবু ত্রিপুর্লিঙ্গ স্বামীজীকে দর্শন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন এবং জমিদার আকুবাবুর পুরানো ঢাকা শহরে করাতিপাড়ায় প্রায় ৪ বিঘা জমির ওপর একটি সম্পত্তি ছিল। আকবাবু মনে মনে এই স্থানটি স্বামীজীকে দান করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। স্বামীজী আকুবাবুর উক্ত প্রস্তাবে সন্মতিজ্ঞাপন করেন। আকুবাবু ও অন্যান্য ভক্তদের সহযোগিতায় ঐ স্থানে একটি বাসপোযোগী মন্দির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয় যা আজ পর্যন্ত স্বামীবাগ আশ্রম নামে সর্বজন পরিচিত। কালক্রমে আশ্রমের নামানুসারে উক্ত পল্লীর নাম হয় স্বামীবাগ। উক্ত আশ্রমে স্বামীজী ১৮৯৯ ইং সালে ১৩০৬ বাংলা ১লা বৈশাখ শ্রীশ্রী ভীম শংকর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন এবং শ্রীশ্রী মঙ্গলা চণ্ডীকেশ্বরী কালিমাতা সহ অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহ স্থাপন করে সেবাপূজা শুরু করেন। দীর্ঘ লীলান্তে শ্রীশ্রী ত্রিপুর্লিঙ্গ স্বামী ১৩২৯ বাংলা (১৯২৩ইং) তাঁর জন্ম তিথি শ্রীশ্রীরামনবমী তিথিতে ১৫০ বছর বয়সে স্বামীবাগ আশ্রমে দেহত্যাগ করেন। দেহত্যাগের পর স্বামীবাগ আশ্রমে স্বামীজীর স্বহস্তে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের পাশেই তাঁর সমাধি মন্দির রচনা করা হয়। ত্রিপুর্লিঙ্গ সরস্বতীর তিন প্রখ্যাত শিষ্য ছিলেন -শ্রীমৎস্বামী নীলানন্দজি, স্বামী শঙ্করানন্দজি ও শ্রীমৎস্বামী নরেশানন্দ সরস্বতী।
সে আজ বহুদিনের কথা- কত দিন গত হইয়াছে তাহা বলা সম্ভব নহে। সন তারিখও কেহই বলিতে পারে না। তখন কান্যকুজে জীবেশ্বর তেওয়ারী নামে এক অতি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বাস করতেন। যে বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তাহার যথেষ্ট মর্যাদা এবং সম্মান ছিল। তৎকালীন পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে জীবেশ্বর তেওয়ারী একজন খ্যাতনাম প্রাজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ বলিয়া সুপরিচিত ছিলেন। কেবল তাহাই নহে, তিনি ভগবৎসাধনপরায়ণ ছিলেন। তিনি একাধারে উচ্চ বংশোদ্ভব ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং সত্যনিষ্ঠ সাধক ছিলেন বলিয়া রাজা মহারাজাগণ পর্যন্ত তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান করিতেন। তাঁহারা পণ্ডিতজীর নিশ্চিন্ত স্বচ্ছন্দ ভরণ-পোষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। উহা হইতে ক্রমে তাঁহার বাৎসরিক আয় প্রায় সাত লক্ষ টাকায় দাঁড়াইয়াছিল। তিনি অতিশয় মহৎ হৃদয় ছিলেন। নিজের পরিবার ভরণপোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য সামান্য মাত্র অর্থ রাখিয়া তিনি আয়ের অবশিষ্ঠাংশ সাধু সজ্জন, ব্রাহ্মণ, অতিথি ও অন্যান্য আতুরদিগের সেবায় ব্যয় করিতেন। তিনি এক সময়ে আসন্ন-প্রসবা সহধর্ম্মিনী শ্রীমতী হরপ্যারী দেবীকে লইয়া মাঘ মেলায় কল্পবাস ও স্নান উপলক্ষে এলাহাবাদ প্রয়াগরাজ ত্রিবেনী সঙ্গমে মাসাধিক কাল বাস করেন। সেখান পণ্ডিতজীর সহিত তাঁহার পূর্ব্ব-পরিচিত কোন এক জীবন্মুক্ত ঋষিকল্প মহাত্মার সাক্ষাৎ হয়। এই মহাত্মাই বহুদিন পূর্ব্বে একদা পণ্ডিতজীর বাটীতে ভিক্ষার জন্য উপস্থিত হইয়াছিলেন। ভোজনান্তে পণ্ডিতজী মহাত্মাজীকে কিছু দিতে চাহিলে তিনি দান গ্রহণ না করিয়া তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে, পুনরায় তোমার সহিত দেখা হইবে কতদিন পরে তাহার ঠিক নাই, সেই সময় তোমার নিকট যাহা চাহিব তোমার সাধ্যানুযায়ী তুমি আমাকে তাহা দিও। আনন্দচিত্তে তখন উহা আমি গ্রহণ করিব।
অনেক দিন পর এইবার ভাগ্যক্রমে উক্ত সন্ন্যাসী প্রবরের সহিত দেখা হওয়ায় পণ্ডিতজী বড়ই আনন্দিত হইলেন এবং সস্ত্রীক ফলফুল দ্বারা তাঁহাকে পূজা করিয়া তাঁহার পাদবন্দনা করিলেন। মহাত্মাজী তখন পণ্ডিত জীবেশ্বরকে চিরপরিচিতের ন্যায় বলিতে লাগিলেন, “আজ তোমার বড়ই শুভ মুহূর্ত্ত উপস্থিত এবং আমিও খুব ধন্যভাগ, আগামী পরশ্ব মৌনী অমাবস্যার স্নান, উক্ত দিবস তোমার সহধর্ম্মিনী অতি তেজবান ধার্ম্মিক একটী সুপত্র প্রসব করিবে। তুমি প্রস্তুত থাক, তোমার পূর্ব্ব অঙ্গীকৃত বাক্যানুসারে এই পূণ্যক্ষেত্র গঙ্গাযমুনা সরস্বতী ত্রিধারা সঙ্গমস্থান ত্রিবেণী তীরে প্রয়াগতীর্থে আমি তোমার সেই নবজাত শিশুকে গ্রহণ করিবার জন্য প্রার্থী হইব। তুমি ধর্ম্মনিষ্ঠ। নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য অবশ্যই আনন্দচিত্তে আমাকে পুত্র সন্তানটী প্রদান করিবে, আশা করি, এমন সুযোগ কখনই তুমি ত্যাগ করিবে না। বহু পূণ্যফলে ও ভাগ্য প্রভাবে এইরূপ ধর্ম্মলাভের সুযোগ ঘটিয়া থাকে- তোমার মহা পরীক্ষার সময় উপস্থিত।” মহাপুরুষ এইরূপ বলিয়া পণ্ডিতজীর উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই- অন্তর্দ্ধান হইলেন।
পণ্ডিত জীবেশ্বর কিছুক্ষণ পরে যেন হৃত-চৈতন্য পুনঃ প্রাপ্ত হইয়া সমস্ত ঘটনা মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন এবং স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, এই মহাত্মাজীর পুনরায় দর্শন পাইলাম এবং আরও সৌভাগ্য যে, আমাদের শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করিলে তাহাকে তিনি গ্রহণ করিবেন।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথনও হর্ষ কখনও বা অমর্ষচিত্তে সন্তান দান সম্বন্ধে শুভাশুভ নানাপ্রকার আলোচনা চলিতে লাগিল। কিন্তু স্নেহময়ী জননীর প্রাণ কিছুতেই যেন সান্তনা মানিতে চাহিল না। তাঁহারা কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিতেছিলেন না। তৎপর দিবস গঙ্গার ঘাটে একজন দৈবজ্ঞ ভ্যাঁট ব্রাহ্মণের সহিত পণ্ডিতজীর দেখা হইল। তিনি পণ্ডিতজীতে দেখিবামাত্রই হাসিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ ক্যা পণ্ডিতজী তোমার কাছে শোচ্তা হ্যায়! দো এক রোজ্ মে তোম্হারা ঘরপর কৈ মহাত্মাকা আবির্ভাব হোগা, তোম্ ধন্যবাগ।”
দেখিতে দেখিতে সেদিনও কাটিয়া গেল। পরদিন অতি প্রত্যুষে মৌনী অবাবস্যা স্নানের জন্য দলে দলে যাত্রীগণ ত্রিবেণী সঙ্গমে যাইতেছে, কত সাধু, সন্ন্যাসী, বৈরাগী, উদাসী আনন্দে মত্ত হইয়া নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক ধ্বজা উড়াইয়া আপন আপন রুচিগত ঈশ্বরবাচক ধ্বনিতে দিক্ মণ্ডল মুখরিত করিয়া গৃহস্থ যাত্রীদিগের প্রাণে ভক্তির প্রস্রবণ প্রবাহিত করিতে করিতে সারি সারি ভাবে স্ত্রোত প্রবাহের ধারার ন্যায় ত্রিবেণী সঙ্গমে মিলিত হওয়ার জন্য ধীর পদবিক্ষেপে গমন করিতেছেন। পণ্ডিতজীও ভগবানের নাম স্মরণপূর্ব্বক গাত্রত্থান করিয়া শৌচাদি কর্ম্ম সমাপনান্তে সস্ত্রীক তাহাদের সহিত মিলিত হইয়া চলিতে লাগিলেন। আসন্নপ্রসবা নমিতাঙ্গী সাধ্বী হরপ্যারী অতি ধীরে ধীরে ভক্তি-আবেগভরে অন্যান্য পরিচিত ও অপরিচিত নানাদেশীয় যাত্রীগণের সহিত ত্রিবেণীর দিকে মৌনভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
যথারীতি স্নানদানধ্যানাদি কর্ম্ম সমাপনান্তে পুনরায় বাসাবাটীর দিকে ফিরিলেন। পথিমধ্যে হরপ্যারী যেন একটা শারীরিক অসুস্থত বোধ করিতে লাগিলেন। গৃহে উপস্থিত হইয়াই প্রসব ব্যাথায় তিনি আকুল হইয়া পড়িলেন। পণ্ডিতজী বিদেশে এই অবস্থায় ক্ষণেকের তরে একটু বিচলিত হইলেন কিন্তু বেশীক্ষণ তাঁহাকে ভাবিতে হইল না। তিনি যে বাড়ীর ভাড়াটিয়া ছিলেন তথাকার পুরমহিলাগণ ইতিমধ্যেই স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহারা এই আপদকালে সকলেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া একে একে হরপ্যারীর নিকট উপস্থিত হইলেন। অতি অল্প সময় মধ্যেই হরপ্যারী অতি সুশ্রীকান্তি ও দিব্যজ্যোতিঃসম্পন্ন একটী পুত্র সন্তান প্রসব করিলেন। পুরবাসিনী মহিলাগণ দেশাচার অনুসারে মাঙ্গলিক কার্য্যসমূহ সম্পাদন করিলেন। সুকোমল বিভূতিকান্তি দিব্যজ্যোতিঃশালী পুত্রমুখ দর্শনে পণ্ডিতজীর মনে এক অব্যক্ত আনন্দ প্রবাহ বিদ্যুচ্ছটার ন্যায় ক্ষণেকের তরে প্রকাশ পাইয়া মহাত্মাজীর কথা স্মরণ করিয়া পুনঃ হৃদয়াকাশেই লীন হইল। তিনি কায়মনোবাক্যে ঈশ নাম স্মরণ করিয়া তাঁহাকে বিনীত কৃতজ্ঞতা জানাইলেন।
মহাত্মাজী কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বালকের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাঁহাকে পণ্ডিতজীর ক্রোড়ে তুলিয়া দিয়া বলিলেন, “তুমি অতি সাবধানে ও পবিত্রতার সহিত এই শিশুর প্রতিপালন ভার গ্রহণ কর। সময় মত আমি ইহাকে বৈদিক সংস্কারে সংস্কৃত করিয়া তোমার নিকট হইতে লইয়া যাইব।” এই বলিয়া তাঁহারা গাত্রোত্থানপূর্ব্বক ভগবানের নাম উচ্চারণ ও আনন্দ প্রকাশ করিয়া যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন।
পণ্ডিতজী সারারাত্রি ধরিয়া কত কিছু চিন্তা করিতে লাগিলেন ক্রমে ক্রমে শেষ তারাটিও নীলাকাশের গায়ে মিলিয়া গেল। বিহগকুজনে পুণ্য ত্রিবেণীভূমি মুখরিত হইয়া উঠিল। ভোরের বাতাস ঈশ গুণগানে নাচিয়া নাচিয়া তাহার মধুর স্পর্শে সকল ক্লান্তি দূর করিয়া শান্তি সুখের আশার সঞ্চার করিয়া জীব জগতকে জাগাইয়া তুলিল। সবেমাত্র রক্তিম রাগরঞ্জিত তরুণ তপন পূর্ব্বাকাশে ধীরে ধীরে তাঁহার প্রথম স্বর্ণরশ্মি গাছপালার উপর ছড়াইয়া দিয়া নৈশ-জড়তা ভাঙ্গিতে আরম্ভ করিয়াছিল। স্যূর্যালোকের এই বিশ্ব জগরণের সঙ্গে সঙ্গে আপন কুটীরে নবসূর্য্যবিনিন্দিত দিব্য জ্যোতিষ্মান বালককে পুনরায় পাইয়া মায়ের প্রাণ পূর্ব্বদিনের সব শোকতাপ শ্রান্তি ভুলিয়া বিমল আনন্দে যেন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
দেখিতে দেখিতে প্রয়াগধামে তাঁহাদের আরও চৌদ্দদিন কাটিয়া গেল। পৌর্ণমাসী স্নান করিরা আজ তাঁহারা দেশে যাত্রা করিবেন। প্রাতঃকালে উঠিয়াই তাঁহারা ত্রিবেণীতে চলিয়া গেলেন, স্বামী স্ত্রী উভয়েই স্নান করিয়া নবজাত শিশুকেও স্নান করাইলেন। তৎপর ব্রাহ্মণ অভ্যাগতগণকে সাধ্যমত যথাযোগ্য অর্থ ও বস্ত্র দান করিলেন এবং ভোজনদানে তৃপ্ত করিয়া বাসাবাটীতে ফিরিলেন। সেখানে এই কয়েক দিনের মধ্যেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশ একটু আত্মীয়তা ও ভালবাসার মত প্রগাঢ় ভাববন্ধন হওয়াতে তাহারাও শিশুর প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হইয়াছিলেন,তাই বিদায়ের দিনে সকলেই একত্রে অতিশয় আনন্দের সহিত একটী প্রীতিভোজে মিলিত হইলেন ।
ত্রিবেণী থেকে গৃহে প্রত্যাগমন
যাইবার আয়োজন সম্পূর্ণ করিয়া পণ্ডিতজী সন্ধ্যার একটু পূর্ব্বে শুভক্ষণে যাত্র করিয়া বাহির হইলেন। তখনকার দিনে রেলপথ ছিল না, গরুর গাড়ীতেই লোক বেশী যাতায়াত করিত এবং ডুলি, পাল্কি, উট, ঘোড়া প্রভৃতি যান-বাহনের ব্যবহারও ছিল। তাঁহারা গরুর গাড়ীতে কিছুদূর যাইবেন এবং সেখানে ডুলি করিয়া হরপ্যারী সন্তনকে লইয়া যাইবেন এবং নিজে ও ভৃত্য পায়ে হাটিয়া যাইবেন। এইরূপ মনস্থ করিয়া প্রয়াগধাম হইতে তাঁহারা গরুর গাড়ীতে রওনা হইলেন। ঐ অঞ্চলে প্রখর সূর্য্য কিরণের জন্য দিবাভাগে দীর্ঘপথ গমনাগমন অপেক্ষা রাত্রিতে ঠাণ্ডায় যাত্রীগণ বেশী চলাচল করিয়া থাকেন।
চোর ডাকাত ও বন্য জন্তুর ভয়ে ঐ অঞ্চলে একক রাস্তায় চলা বড়ই মুস্কিল। এজন্য পণ্ডিজীকে বড়ই অসুবিধায় পড়িতে হইল কারণ প্রথম স্নানের পরে এই কয়দিনের মধ্যে ঐদিকের যাত্রীরা প্রায় সবই চলিয়া গিয়াছে। রাত্রি প্রায় বারোটার সময় তাঁহারা নির্ব্বিঘ্নে একটী বড় আড়ৎ মোকামে আসিয়া পৌঁছিলেন। রাতদিন পথ চলিতে হইবে। নতুবা লক্ষে্নৗ পৌঁছিতে অত্যন্ত দেরী হইয়া যাইবে এবং রাস্তায় যথেষ্ট কষ্ট পাইতে হইবে। ইহার পরবর্তী ঘাটিতে যাহাতে রাস্তা বিপদসঙ্কুল, এই কারণে এই স্থান হইতে যাত্রীগণ সঙ্ঘবদ্ধ না হইয়া যাত্রা করে না।
পশ্চিম-উত্তর অঞ্চলে দুর্গম রাস্তায় কোন গাড়ীই একক চলে না। পণ্ডিতজী দেখিলেন সেখানে একখানা গাড়ীও নাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া স্থানীয় লোকের নিকট হইতে শুনিলেন অল্পকাল আগেই কয়েকখানা গাড়ী রওনা হইযা গিয়াছে। সেই গাড়ীগুলির সহিত মিলিত হইবেন এই ভরসায় তিনি কালবিলম্ব না করিয়া যাত্রা করিলেন। তিন চার মাইল গেলেই ব্যাঘ্রাদি বন্যজন্তু ,সমাকূল একটী বিস্তৃত বন এবং স্থানে স্থানে নিশাচর ডাকাতের উৎপাত। বিপদসঙ্কুল দুর্গম জঙ্গলের মধ্য দিয়াই যাইবার রাস্তা। তিনি দেবাদিদেব মহাদেবকে স্মরণ করিয়া সেই বনপথে যাত্রা করিলেন এবং অতি শঙ্কিত চিত্তে পথ চলিতে লাগিলেন। অনতিদূরেই রাস্তার পার্শ্বে একখানা গো-শকট ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া আছে। কোন লোকজনের সারা নাই দেখিয়া পণ্ডিতজীর মনে খুব ভয় হইল। কখন কি বিপদ ঘটে, সুতরাং অগ্রবর্তী গাড়ীগুলিকে শীঘ্র শীঘ্র ধরিবার জন্য গাড়োয়ানকে মাঝে মাঝে তাড়া দিয়া ‘জোড়সে চালাও’ বলিয়া তাগিদ দিতে লাগিলেন।
গৃহে প্রত্যাগমন
গভীর অন্ধকার - দুই পাশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল, মাথার উপর বড় বড় গাছের শাখা-প্রশাখায় আকাশম-ল আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে। গাড়ীর ভিতরের স্বল্প আলোকে সামান্য পথ ভিন্ন আর কিছুই দেখা যাইতেছিল না। চারিদিক নিস্তন্ধ, শুধু একটানা ঝিল্লিরব শুনা যাইতেছিল এবং মাঝে মাঝে নৈশ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া নিশাচর পাখী ও জন্তুর বিকট চিৎকার শোনা যাইতেছিল। ইহাতে পণ্ডিতজীর মনে আরও ভীতির সঞ্চার হইতেছিল। শিশু মাতৃক্রোড়ে- নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছিল, মাতা তন্দ্রাবেশে কত কি সুখের স্বপ্ন যে দেখিতেছিলেন কে বলিতে পারে? ভৃত্য আপন মনে গাড়োয়ানের সঙ্গে নিজ বীরত্বের কথা বলিতেছিল- কত ডাকাত দেখিয়াছি, কত লূটপাট করিয়াছি, আমার সঙ্গে পেরে উঠা কঠিন- রহিলখণ্ডিয়া ঔর লক্ষেনৗইয়া দোনো বরাবর হ্যায়। হাতে লাঠি থাকিলে আবার ডর কি আছে।
এই সব দিলদারী কথা হইতেছে এমন সময় আনতিদূরে পথিপার্শ্বে একখানা ভগ্ন শকট দেখিতে পাইয়া পণ্ডিতজী চীৎকার করিয়া উঠিলেন- দেখিতে দেখিতে ডাকাতদল আসিয়া উপস্থিত! পণ্ডিতজী ভীতিবিহ্বল চিত্তে চাহিয়া রহিলেন, গাড়োয়ান চেচাইয়া উঠিল, ভৃত্য লাঠি লইয়া একহাত দেঝাইবার চেষ্টা করিল কিন্তু সমস্তই বিফল হইল।
ডাকাতগণ গাড়ী চড়াও করিল। পণ্ডিতজী কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া অতি বিনীতভাবে তাহাদের নিকট নিজ অবস্থা সমস্তই সরলভাবে বলিতে লাগিলেন এবং নিজের নিকট যাহা কিছু সামান্য অর্থ ছিল তাহা সমস্তই বাহির করিয়া দিলেন। এ সময়ে শিশু কাঁদিয়া উঠিল - মায়ের ঘুম ভাঙ্গিল। ডাকাত দলপতি উঁতি দিয়া চাহিয়া শিশুটীকে দেখিল এবং মনে মনে বুঝিল ব্রাহ্মণ সত্য সত্যই তাঁহার নিজ অবস্থা জানাইয়াছে। নিরীহ ব্রাহ্মণ সামান্য সম্বল লইয়া বিপন্ন অবস্থায় দেশে ফিরিতেছে মনে করিয়া দলপতির হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল। সে তাহার দলের ডাকাতদিগকে ডাকিয়া বলিল “এই সত্যবাদী ব্রাহ্মণের নিকট হইতে যাহা কিছু লইয়াছ সমস্তই ফিরাইয়া দাও। সামান্য অর্থে আমাদের কিছুই উপকার হইবে না। কচি শিশু কুমারের আহার কাড়িয়া লইয়া আমাদের কি লাভ হইবে।”
ডাকাতেরা পণ্ডিতজীকে আর্থ ফেরত দিয়া মুক্তি দিল- উহাদের কেহ কেহ ভৃত্যটীকে উপহাস করিয়া বলিল- “যা তোদের শিশু পরম ভাগ্যবান তাই তাহার ভাগ্যেই সরদারের দয়া হইল এবং তোরাও প্রাণে রক্ষা পাইয়া গেলি।” পণ্ডিতজীও পরম মঙ্গলময় পরমেশ্বরের নাম স্মরণ করিতে করিতে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন এবং মনে মনে ভাবিলেন মহাত্মার গচ্ছিত শিশু যখন আমাদের কাছে আছে তখন আর বোধহয় বিপদের কোনই আশঙ্কা নাই। তিনি পুত্র স্নেহে মুগ্ধ হইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।
প্রয়াগধাম হইতে গৃহে প্রত্যাগমন
ডাকাতেরা পণ্ডিতজীকে আর্থ ফেরত দিয়া মুক্তি দিল- উহাদের কেহ কেহ ভৃত্যটীকে উপহাস করিয়া বলিল- “যা তোদের শিশু পরম ভাগ্যবান তাই তাহার ভাগ্যেই সরদারের দয়া হইল এবং তোরাও প্রাণে রক্ষা পাইয়া গেলি।” পণ্ডিতজীও পরম মঙ্গলময় পরমেশ্বরের নাম স্মরণ করিতে করিতে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন এবং মনে মনে ভাবিলেন মহাত্মার গচ্ছিত শিশু যখন আমাদের কাছে আছে তখন আর বোধহয় বিপদের কোনই আশঙ্কা নাই। তিনি পুত্রস্নেহে মুগ্ধ হইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।
গাড়ী পুনরায় চলিতে লাগিল। এইরূপে বাধাবিঘœ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা ভোরে রাণীগড় আসিয়া পৌঁছিলেন এবং সেখানে জিনিসপত্র নামাইয়া গাড়োয়ানকে বিদায় দিয়া প্রাতকালীন স্নানাহারের বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। ভৃত্য জয়রাম সমস্ত যোগাড় করিয়া দিল। ডালরুটি প্রস্তুত করিয়া আহারাদির পর শিশুর জন্য দুগ্ধ সংগ্রহ করিয়া পুনরায় ডুলি পথে তাঁহারা যাত্রা করিলেন। পত্নী শিশুসহ ডুলিতে উঠিলেন এবং ভৃত্য জয়রাম ও পণ্ডিতজী পদব্রজে চলিলেন। যখন তাঁহারা রওনা হইলেন তখন বেলা প্রহরে সন্ধ্যার প্রাক্কালে প্রায় চৌদ্দ ক্রোশ রাস্তা অতিক্রম করিয়া নিজ জেলার অন্তর্গত রামুনিয়া গ্রামের এক প্রাচীন চটিতে আসিয়া তাঁহারা পৌঁছিলেন। এখানে পণ্ডিতজীকে না চেনে না জানে এমন লোক খুব কম। এখানে তিনি নিকটবর্ত্তী এক রাজার আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। রাজা মহাসমাদরে প-িতজীর সেবা ও সৎকার করিলেন। ঐদিন সেখানে বিশ্রাম করিয়া পরদিন রাজার সাহয্যে দেশে যাত্রা করিলেন।
আজ পণ্ডিতজী সত্য সত্যই মহা আনন্দিত। রাস্তায় যাহা কিছু বাধা বিপত্তি আসিয়াছিল তাহা অনায়াসেই কাটিয়া গিয়াছে, এখন দেশের কাছে আসিয়া পড়িয়াছেন সুতরাং শীঘ্রই বাড়ীতে উপস্থিত হইবেন। ভৃত্য জয়রামকে অশ্বারোহণে পূর্ব্বেই খবর দিবার জন্য পাঠাইয়া দিয়াছেন। জয়রামের কাছে খবর পাইয়া জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবনারায়ণ ও দ্বিতীয় পুত্র জীবরাম ভিষন আনন্দিত হইলেন। অনেকদিন তাহারা পিতাজীর খবর পায় নাই সুতরাং দুই ভাই পিতাজীর সহিত সাক্ষাৎ ও নবজাত ভাইটীকে দেখিবার জন্য অশ্বারোহণে বাহির হইয়া পড়িলেন। পথেই পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইল। পুত্রদ্বয় পিতার পদধূলি গ্রহণ করিয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। পিতা পুত্রদ্বয়ের মস্তক আঘ্রাণ করিয়া পরমানন্দ চিত্তে তাহাদের আশীর্ব্বাদ করিলেন। তাহারা নবজাত ছোট ভাইটীকে দেখিবার জন্য উৎসুক হইয়া মাতার নিকট গেলেন এবং মাতাকে প্রণাম করিয়া সানন্দে ভাইটীকে দর্শন করিলেন। রাত্রি প্রথম প্রহরের মধ্যেই তাহারা সকলে বাড়ীতে পৌঁছিয়া সহাস্য বদনে পরিজনবর্গের সানন্দ অভ্যর্থনা গ্রহণ করিলেন। আজ রাত্রি কি দিন কে বলিবে- পরিজন প্রতিবেশী সকলেই আসিয়া উপস্থিত। বাড়ী আজ আলোকমালায় আলোকিত এবং নানাবিধ বাজনায় চতুর্দ্দিক মুখরিত।
বেণীমাধব তথা ত্রিপুর্লিঙ্গ সরস্বতীর পিতা পণ্ডিতজীর সর্ব্ব শাস্ত্রেই সমান অধিকার ছিল। তিনি জ্যোতিষী মতে জাতকের জন্ম-কুণ্ডলী প্রস্তুত করিয়া নিজেই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করিয়া দেখিলেন যে নবজাত কুমার একজন অসাধারণ দিব্যশক্তিশম্পন্ন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হইবেন। তিনি পার্থিব কর্ম্মে লিপ্ত থাকিলে রাজত্ব, প্রভুত্ব ও পরমার্থ লাভ অবশ্যম্ভাবী অথবা ধর্ম্মধ্যক্ষযোগে তিনি একজন অদ্বিতীয় মহাপুরুষ হইবেন। ইহার কুণ্ডলী বিশেষ ভাবে বিচার করিলে সংসারশ্রম ও ত্যাগাশ্রম উভয় পথেই বিশেষ শক্তিশালী গ্রহবল দেখা যায়। পণ্ডিতজী কুমারের জন্মকালীন সমস্ত যোগাযোগ ও ঘটনাবলী মনে মনে চিন্তা করিয়া বুঝিলেন শিশু কুমার নিশ্চয়ই প্রাপ্ত বয়সে মহাত্মার সহিত চলিয়া যাইবেন, ইহাকে কিছুতেই গৃহস্থাশ্রমে রাখা সম্ভব হইবে না।
ক্রমে কুমারের নামকরণের সময় আসিল। প্রয়াগতীর্থে জন্মিয়াছে বলিয়া পণ্ডিতজী জাতকের প্রয়াগনারায়ণ এবং জীবানন্দ নাম রাখিলেন। জাতকের ত্রিবেণীতীর্থে জন্ম হওয়ায় মাতা বেণীমাধব বলিয়া ডাকিতেন। দেখিতে দেখিতে কয়েক বছর কাটিয়া গেল। পঞ্চম বর্ষে ছেলের হাতে খড়ি দেওহা হইল। বলা বাহুল্য সমস্ত বৈদিক সংস্কারই মহাধূমধামের সহিত অনুষ্ঠিত হইল। পণ্ডিতজী রাজরাজাদিকের নিকট শিশু জন্নিবার পরে তাঁহার ধন সম্পত্তি আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ছেলের হাতেখড়ি দেওয়া হইল বটে কিন্তু লেখাপড়ায় তাঁহার খুব একটা মনোযোগ দেখা গেল না। লেখাপড়া করা অপেক্ষা তিনি সমবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে খেলাধূলা ইত্যাদি নানারূপ আমোদপ্রমোদই বেশী পছন্দ করিতেন। ক্রমে তাঁহার উপনয়ন সংস্কারের সময় উপস্থিত হইল এবং যথারীতি তাঁহাকে উপনয়ন দেওয়া হইল।
বেণীমাধবের মহাত্মাজীর সঙ্গে গমন
উপনয়ন হওয়ার কিছুদিন পরেই পূর্ব্বোক্ত মহাপুরুষ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হর্ষামর্ষচিত্তে যথেষ্ট সমাদরের সহিত পাদ্যার্ঘ দ্বারা পূজা করিয়া পণ্ডিতজী মৌনভাবে করযোড়ে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মহাত্মা পুত্রটীকে দেখিতে চাহিবামাত্র বেণীমাধবকে তাঁহার নিকট আনা হইল। মহাত্মাজী কুমারকে দর্শন করিয়া পরম প্রীতি লাভ করিলেন এবং সস্নেহে বলিলেন, “বৎস তোমার বিদ্যাভ্যাস কি যথারীতি হইতেছে?”
বেণীমাধব আর কি উত্তর দিবেন তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। পণ্ডিতজী দুঃখিতচিত্তে বলিলেন, “মহাত্মন্, বালকের লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ নাই বলিয়াই মনে হয়।”
মহাত্মা বলিলেন, “সেজন্য আক্ষেপ করিবার কিছুই নাই, বৎস অনেকদিন কাটিয়া গেল, সুতরাং এখন চল আমার সঙ্গে একবার বন্যভূমি ভ্রমণ করিবে।”
বেণীমাধব এই কথা শুনিয়া আহলাদের সহিত বলিলেন, “ইহা কি আমার ভাগ্যে ঘটিবে।” এই বলিয়া দৌড়াইয়া মাতার নিকট গিয়া পরমানন্দে কহিলেন, “মা আমি আজই মহাত্মজীর সঙ্গে বন্যভূমি দর্শন করিতে যাইব।”
মায়ের মন এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় কাঁদিয়া উঠিল। তিনি মুখে বলিলেন, “যাবে বৈ কি, একটু বড় হইলেই তোমার দাদাদের সহিত যাইতে পারিবে।” মাতা পুত্রকে নানভাবে সব সময়ই মায়ের নিকট আব্দার করিতেন সুতরাং মায়ের কোন কথাই তখন কাজে আসিল না। তিনি মহাত্মাজীর সঙ্গে যাইতে কৃতসংকল্প হইলেন। পূর্ব্ব জন্মার্জ্জিত সংস্কার যেন তাঁহার অন্তরে জাগিয়া উঠিল। মাতার অশ্রুজল, পিতার বুঝপ্রবোধ তাঁহার সংস্কার প্রণোদিত চিত্তকে মায়া স্নেহ মুগ্ধ বা বিচলিত করিতে পারিল না। মহাত্মাজীর সহিত গেলে আর লেখাপড়া করিতে হইবে না, বেশ মজায় দিনগুলি কাটিয়া যাইবে কাজেই এ সুযোগ কোন ক্রমেই ত্যাগ করিতে তিনি সম্মত হইলেন না। মহাত্মাজীর সেবা-পূজান্তে পণ্ডিতজী পূর্ব্বকৃত অঙ্গীকার অনুযায়ী বেণীমাধবকে তাঁহার হাতে সমর্পণ করিয়া প্রস্তরমূর্ত্তির ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন, মাতা কাঁদিয়া উঠিলেন।
গৃহত্যাগ করিয়া মহাত্মাজীর সঙ্গে বেণীমাধব
বেণীমাধবের বিদায়ে আজ বাড়ীর সকলেই বিষন্ন, সকলেই স্তব্ধ, কোথাও সারা শব্দ নাই! পণ্ডিজী হৃদয়ে দারুণ আঘাত পাইলেও কর্ত্তব্য অনুরোধে অপত্যস্নেহ সম্বরণ করিয়া একান্ত অধীরচিত্ত পত্নী হরপ্যারীকে নানাপ্রকার উপদেশ দিয়া বুঝাইতে লাগিলেন কিন্তু মায়ের হৃদয়ের আবেগ প্রশমিত হইল না। তাঁহার সকল উপদেশই স্ত্রোতমুখে তৃণের ন্যায় ভাসিয়া গেল। হরপ্যারী জীবন্মৃত অবস্থায় কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। বেণীমাধব কোন দিকে দৃকপাত না করিয়া কি যেন এক নূতন আনন্দে বিভোর হইয়া হাসিমুখে বন্যভূমির কন্টকাবৃত লতাগুল্ম সমাকীর্ণ পথ অতিক্রম করিয়া রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের সময় একটী পর্ব্বতের পাদদেশে পর্ণকুটীরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মহাত্মাজী কুটীরের দ্বার খুলিয়া বেণীমাধবকে লইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রামান্তে আহারের জন্য বেণীমাধবকে কিছু ফলমূল দিয়া নিজেও কিছু আহার করিলেন। তারপর পথশ্রমে কাতর বালক পার্ব্বত্য অঞ্চলের নানারূপ গল্প শুনিতে শুনিতে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমাইয়া পড়িলেন। পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া তিনি হাত মুখ ধুইয়া স্নানের জন্য নিকটবর্ত্তী একটি পার্ব্বত্য নদীতে গমন করিলেন।
পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া তিনি হাত মুখ ধুইয়া স্ননের জন্য নিকটবর্ত্তী একটি পার্ব্বত্য নদীতে গমন করিলেন।
এখানকার নদীর তীরবর্ত্তী প্রাকৃতিক শোভা পরম রমনীয়। সুদৃশ্য শ্যামল তরুরাজী নানা ফল ফুলে সুশোভিত। এক দিকে অতি উচ্চ পর্ব্বত শিখর প্রভাত সূর্য্যরে স্বর্ণ কিরণে উদ্ভাসিত। কি সুন্দর! কেমন মন মাতান দৃশ্য! বেণীমাধবের সব কিছু যেন কেমন ভুল হইতে লাগিল। তিনি প্রকৃতির এই অপূর্ব্ব শোভার মধ্যে নিজেকে এক অভূতপূর্ব্ব আনন্দস্ত্রোতে ভাসাইয়া দিলেন। কি আনন্দ! কতক্ষণ এইভাবে ছিলেন বলিতে পারেন না, এরূপ আনন্দ তিনি জীবনে আর কখনও অনুভব করেন নাই। বেণীমাধব বহুক্ষন পর স্নান শেষ করিয়া পরম আনন্দ মনে লইয়া কুটীরে ফিরিলেন। তাহার মুখে চোখে যেন আনন্দ প্রবাহিত হইতেছে। মহাত্মাজী তাহার অবস্থা দর্শনে মনে মনে ভবিষ্যত আশার একটা কল্পনা করিতে লাগিলেন।
কুটীরের অনতিদূরেই পার্ব্বত্যজাতির বাসস্থান। বেণীমাধব অনেক সময় উহাদের সহিত নানারকম কথাবার্ত্তায় সময় কাটান। কখনও বা তাহাদের সহিত তীর ধনুক চালনা অভ্যাস করেন, আবার কখনও বা তাহাদের সহিত পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুড়িয়া বেড়ান। সেখানে বেণীমাধব কোনপ্রকার দৈহিক কষ্টকেই গ্রাহ্য করিতেন না। ফলে বনপ্রদেশে পরমানন্দেই তাহার দিন কাটিতেছিল। মাঝে মাঝে অবসর মত মহাত্মাজীর নিকট শাস্ত্রোপদেশ ও যোগসম্বন্ধে উপদেশ শোনেন। বেণীমাধব যে কাজেই হাত দেন অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাহার আয়ত্ত করিয়া ফেলেন। এইরূপে প্রায় ছয় সাত বৎসর অতিবাহিত হইল।
এখন ক্রমেই তাহার চঞ্চল ভাব যেন কমিয়া আসিতেছে এবং ক্রমেই শান্তভাবের স্নিগ্ধচ্ছটায় তাহার বদনম-ল অপূর্ব্ব সুন্দর হইয়া উঠিতেছে। তিনি আজকার অনেক সময়ই নির্জ্জনে থাকিতে ভালবাসেন। একদিন পাহাড়ে বেড়াইতে বেড়াইতে তিনি এক পরম রমণীয় স্থানে আসিয়া বসিলেন। স্থানটি খুবই নির্জ্জন। পাহাড়ের উচু নীচু বিচিত্র শিখর সমূহের নানারূপ প্রাকৃতিক গঠন, তাহাতে আবার বিচিত্র বর্ণের ফুল লতা পাতা ও ফল শোভিত বৃক্ষরাজি দেখিতে দেখিতে বেণীমাধব তন্ময় হইয়া পড়িলেন- তাঁহার মন এক অজানা ভাবপ্রবাহে ভরিয়া গেল। তিনি যেন তন্ময় হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ এইরূপ ভাবপ্রবাহে মগ্ন থাকর পর তিনি আত্মস্থ হইয়া ধীরে ধীরে কুটীরে ফিরিয়া আসিলেন।
মহাত্মাজী যখন তাঁহাকে উপদেশ দিতেন তখন মাঝে মাঝে বেণীমাধব বেশ সুন্দর যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন করিতেন। তিনি যাহা কিছু কাজ কর্ম করেন বা দেখা শুনা করেন তাহার মধ্যে গুরুর উপদেশ মতে শাস্ত্রাদির বিষয়গুলি ব্যবহারিক ভাবে প্রয়োগ করা কতটা সম্ভব এবং কতদূর সত্য তাহা অনুসন্ধান করিবার জন্য সর্ব্বদাই তাহার মনে একটা চিন্তা প্রবাহাকারে ঘুরিতে থাকিত। তিনি সর্ব্ব বিষয়ের মধ্যেই সত্যের অনুসন্ধান করিতেন।
আজ বেণীমাধবের মনটা যেন একটু বিষন্ন, তাই চুপচাপ বসিয়া আছেন। তেমন স্ফূর্ত্তির ভাব নাই, মাঝে মাঝে বাড়ীর কথা, পিতামাতার কথা, ভাইদের ¯েœহ ভালবাসা ও খেলার সাথীদের সঙ্গে প্রীতিমাখা সর্ম্পকের কথা মনে হইতেছে। বড়ই উদাসীনভাব, আজ আর সান্ধ্যাক্রিয়া, শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন অথবা উপদেশ শ্রবণ কোন কিছুতেই তাহার মন বসিতেছে না। মহাত্মাজী প্রিয়তম শিষ্যের এই উন্মনাভাব দেখিয়া একটু মনঃসংযম করিয়াই ব্যাপারটি বুঝিতে পারিলেন কিন্ত সে রাত্রে তিনি তাহাকে আর কিছুই বলিলেন না। পরদিন বেণীমাধব যথারীতি প্রাতঃক্রিয়া সমাপন করিয়া হৃষ্টদিত্তে গুরজীর নিকট উপস্থিত হইলেন। গুরুজী সহাস্যে তাঁহার শারীরিক ও মানসিক কুশল প্রশ্ন করিয়া তাঁহাকে শাস্ত্রোপদেশ দিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বেণীমাধব শাস্ত্রাদি পাঠ করিতে বিশেষ পছন্দ করিতেন না, শুনিতেই বিশেষ পছন্দ করিতেন। যাহা কিছু তিনি শুনিতেন তাহাই তাঁহার স্মৃতিতে অক্ষয়ভাবে থাকিয়া যাইত।
উপদেশ সমাপনান্তে গুরুজী সস্নেহে বেণীমাধবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস, দুই একদিনের মধ্যেই আমার ইচ্ছা তোমাকে লইয়া কান্যকুব্জধামে যাই, যদি তোমার মত হয় তবে আজিও যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে পার।” বেণীমাধব ইহাতে সম্মতি জানাইলেন। রওনা হইবার পূর্ব্বে কিছু আহার করিয়া লওয়া দরকার ভাবিয়া মহাত্মাজীর অনুমতি লইয়া বেণীমাধব সত্বর কিছু ফল মূল লইয়া আসিলেন। গুরুজী কিয়দংশ গ্রহণ করিয়া অবশিষ্ট বেণীমাধবকে খাইতে দিলেন। তারপর উভয়ে কুটীর পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে পাহাড় হইতে নামিয়া গ্রামাভিমুখে পথ ধরিলেন।
বেণীমাধবের পুনরায় গৃহে প্রত্যাতর্ত্তন
ক্রমে তাঁহারা অনেক গ্রাম বসতি অতিক্রম করিয়া পণ্ডিতজীর বাড়ীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। পণ্ডিত জীবেশ্বর মহাত্মাকে পাদ্যার্ঘ্য দিয়া মহানন্দে পদবন্দনা করিলেন এবং পুত্রের মস্তক আঘ্রাণ করিয়া শুভাশীর্ব্বাদ করিলেন। মহাত্মাজী বলিলেন, “বেণীমাধবকে আমি কিছুদিনের জন্য সংসারাশ্রমে রাখিতে চাই। ইহার ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম সমাপ্ত হইয়াছে। এখন বিবাহ দিয়া ইহাকে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করাইতে হইবে।”
“বিবাহ অন্তে কিছুদিন গৃহস্থাশ্রমে কাটিলে পর সময়মত আসিয়া আমি ইহাকে লইয়া যাইব। তোমরা কোনও চিন্তা করিও না, বেণীবাধব আমার পরম প্রিয়তম। তথাপি কর্তব্যানুরোধে ইহার যে অল্প সময় সংসার ভোগ রহিয়াছে সেই সময়টুকুর জন্য ইহাকে তোমার ন্যায় নিষ্ঠাবান পিতার নিকট রাখিয়া যাইতেছি। ইহাকে শাস্ত্র সম্বন্ধে যাহা কিছু উপদেশ দিয়াছি, তুমি ইহার সহিত আলাপ করিয়া তাহা জানিতে পারিলে সুখী হইবে।” বেণীমাধবকে ডাকিয়া তাহার মস্তকে আশীর্ব্বাদ মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া মহাত্মাজী বলিলেন, “বৎস, আমি এখন ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিব, তুমি কিছুদিন পিতার নিকট থাকিয়া সংসারাশ্রম ধর্ম্ম পালন কর।” বেণীমাধব তাঁহার সঙ্গে যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন কিন্তু মহাত্মাজী নানারূপ শাস্ত্রবাক্য দ্বারা তাহাকে বুঝাইয়া ক্ষান্ত করিয়া সেখান হইতে বিদায় লইলেন।
মহাত্মাজীর অভাবে বেণীমাধবের মনটা খুবই যেন অধীর হইয়া পড়িল। একাদিক্রমে একাদশ বৎসর কাল এই সুদীর্ঘকালের কত মধুর স্মৃতি তাহার ব্রহ্মচর্য্যাশ্রাম কাটিয়াছে। এই মহাপুরুষজীর সঙ্গ বিচ্ছেদ জনিত দুঃখ আজ বেণীমাধবের প্রাণে খুব বেশী করিয়াই বাজিল। কয়েকদিন তাঁহার কিছুই ভাল লাগিল না। ধীরে ধীরে তিনি পুনরায় বাল্য সখা ও খেলার সাথীদের সঙ্গে মিশিতে লাগিলেন এবং অবসর মত পিতার সাথে শাস্ত্রীয় আলাপ আলোচনাও করিতে লাগিলেন। প-িতজী পুত্রের শাস্ত্রসম্পর্কিত প্রশ্ন ও ব্যাখ্যা শুনিয়া অত্যন্ত সুখী হইতেন এবং নিজেকে ধন্যভাগ মনে করিতেন। মাতাজী হরপ্যারী দেবী নানাপ্রকার খাদ্য তৈয়ারী করিয়া পুত্রের নিকট আনিলে অতি আনন্দের সহিত তিনি মাতার হাত হইতে উহা গ্রহণ করিতেন কিন্তু সামান্য মাত্রই ভোজন করিতেন। ভ্রাতাদের সঙ্গে পরমানন্দে স্নান আহার ও খেলা করিতেন। এইরূপে তাঁহার সাংসারিক চালচলন সবই ঠিকভাবে চলিতেছিল কিন্তু তাহা সত্ত্বেও কেমন একটা উন্মনা ভাব যেন তাঁহার দিব্যজ্যেতিসম্পন্ন প্রশান্ত মুখম-লে সর্ব্বদাই বিরাজমান থাকিত। সকলেই তাঁহার দর্শনে আনন্দিত এবং তাঁহার বাক্যালাপ শুনিয় সুখী হইত।
বেণীমাধবের বিবাহ ও গৃহত্যাগ
এইরূপে এক বছর কাটিয়া গেলে, মহাত্মাজীর আদেশ মত প-িতজী পুত্রের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিয়া সুলক্ষণা শ্রীমতী গঙ্গাদেবীর সহিত যথারীতি বিবাহ সংস্কার সম্পাদন করিলেন। গঙ্গাদেবী একাদশ বর্ষীয়া বালিকা। এই বালিকার সহজ সরল ভাব দেখিয়া বেণীমাধবের সেই পার্ব্বত্য বালিকাদের সরলতামাখা ব্যবহারের কথা মনে হইতে লাগিল। তিনি গঙ্গাদেবীর সরল কথাবার্ত্তায় বিশেষ আনন্দ পাইতেন। সে আনন্দ সংসারের কুটীলতা বিজড়িত নয় বরং দেবভাবযুক্ত ও শাস্ত। বিবাহ বন্ধনের পর সংসার আশ্রমে তাঁহার তিন বৎসর কাটিয়া গেল, চতুর্থ বৎসরে গঙ্গাদেবী দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন এক পুত্র প্রসব করিলেন। ফলে, আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই মহাআনন্দিত- সকলেই যেন পরমসুখ বোধ করিলেন।
একদা নিশীথে বেণীমাধব নিদ্রিতাবস্থায় স্বপ্ন দেখিলেন, মহাত্মাজী সস্নেহে তাঁহার মস্তকে হাত দিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া অতি আদরের সহিত তাঁহাকে বলিতেছেন, “বৎস, এখনও কি ভোগ বিলাসে তোমার তৃপ্তি হয় নাই। পুত্র মুখ দর্শন করিয়া কি আরও মোহে পড়িবে। আর কেন? এখনই চলিয়া আইস। বৃথা সময় নষ্ট করিও না।” স্বপ্ন দেখিয়া তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তখন মধ্যরাত্রি। উঠিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। ক্রমে ভোর হইয়া আসিল- জীবজগত প্রত্যেকেই জাগ্রত হইয়া আপন আপন কার্য্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িল কিন্তু বেণীমাধব বারংবার কেবল রাত্রির স্বপ্নকথা স্মরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার মন থাকিয়া থাকিয়া কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল। আর এক মুহূর্ত্তের জন্যও লোকালয়ে তাঁহার ভাল লাগিতেছে না, কেবল গুরুজীর কথাই মনে হইতেছে। আর মনে হইতেছে সেই ভাবযুক্ত পাহাড়ী বালক বালিকাদের প্রীতিমাখা সহজ সরল ব্যবহার ও অরণ্যের নির্জ্জন বক্ষে নানাবিধ বিহগকূজন, লতাপাতা ও ফলমূল সুশোভিত দৃশ্য এবং গুরুজীর সহিত বেদান্তের তত্ত্বানুসন্ধান ও যোগ সম্বন্ধীয় নানাপ্রকার ক্রিয়া কলাপের কথা।
পুত্র মুখ দর্শন জনিত কোন প্রকার মায়া মোহই আর তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না। এই সময় বেণীমাধবের বয়স বাইশ কি তেইশ বৎসর হইবে। তিনি সর্ব্বদাই কি যেন এক ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া শ্রীগুরুজীর আগমন প্রতীক্ষায় দিন কাটাইতে লাগিলেন। পরদিন প্রত্যুষে উঠিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে পিতার নিকট তিনি নিজের মনের ভাব জ্ঞাত করিয়া সেই দিনই শ্রীগুরুজীর উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগের কথা জানাইলেন। গুরুর জন্য তাঁহার মনপ্রাণ পাগল হইয়া উঠিল বুঝিতে পারিয়া পণ্ডিতজী গৃহিণীকে সবকথা জানাইলেন। মাতার প্রাণ প্রথমতঃ একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল কারণ বেণীমাধব যে মায়ের বড়ই আদরের সন্তান।
বেণীমাধব যখন বিদায় গ্রহণ করেন শিক্ষিত ধর্ম্মনিষ্ঠ পিতা মাতার মুখমণ্ডলে তখন কোনও প্রকার বিমর্ষ ভাব দেখা যায় নাই। তাঁহারা মনের সমস্ত ব্যথা বেদনা গোপন রাখিয়া গম্ভীর মুখে প্রাণপ্রিয় পুত্রকে বিদায় দিলেন। বেণীমাধব পিতামাতার চরণ বন্দনা করিয়া একবার সহধর্ম্মিণী গঙ্গাদেবীর কাছে যাইয়া মৌনভাবে কিছুকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন। গঙ্গাদেবী পূর্ব্বেই এই ব্যাপার কতকটা জানিতে পারিয়াছিলেন তাই মুখে আর তাঁহার কিছু বলিবার মত অবস্থা ছিল না। কেবলমাত্র জলভরা চোখে স্বামীর মুখের দিকে তিনি একবার তাকাইয়া অবনত মস্তকে তাঁহার পায়ে লুন্ঠিত হইয়া প্রণাম করিলেন। বেণীমাধব নবজাত কুমারের মুখের দিকে একবার তাকাইলেন এবং প্রদীপ বৈরাগ্যবলে সমস্ত মায়ামোহ দগ্ধ করিয়া শ্রীগুরুর দর্শন লাভের জন্য তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। গঙ্গাদেবী স্বামীর নিকট হইতে কোন কিছুই জানিতে পারলেন না। তাহার পরমপ্রিয় প্রাণের আরাধ্য পতি দেবতা আজ চিরজীবনের জন্য অথবা কতদিনের জন্য কোথায় চলিয়া যাইতেছেন তাহা তাঁহার কাছে অজ্ঞাতই রহিয়া গেল।
গৃহত্যাগ ও গুরুবিয়োগ
আজ বেণীমাধব সংসারের প্রিয়জন পিতামাতা, স্ত্রী, পুত্র ভাইবোন সমস্ত পরিজনবর্গের মায়া মহাবীরের ন্যায় ছিন্ন করিয়া উদাস প্রাণে অতি প্রিয়তম আপ্তজন শ্রীগুরুর উদ্দেশ্যে পথে বাহির হইলেন। দু’প্রহর পর্য্যন্ত পথ চলিয়া পরিশ্রান্ত হইয়া পথিমধ্যে এক অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় তিনি বিশ্রাম করিতে বসিলেন ও অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমাইয়া পড়িলেন। এমন সময় হঠাৎ শ্রীগুরুর সেই চিরপরিচিত প্রীতি-মধুর কন্ঠ ধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল এবং তিনি চমকিয়া উঠিলেন। সন্ধ্যা হইতে আর বিলম্ব নাই, পাশে গুরুজী বসিয়া আছেন। বেণীমাধব শ্রীগুরুর পাদবন্দনা করিয়া করযোড়ে তাঁহার সম্মূখে গিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি ‘তোমার ব্রহ্মানন্দ লাভ হউক’ বলিয়া তাঁহাকে আশীর্ব্বদ করিলেন। কুশল প্রশ্নাদির পর উভয়ে কুটীরভিমুখে রওনা হইলেন। নানাবিধ শাস্ত্রীয় আলাপ করিতে করিতে তিনি পথ অতিবাহিত করিয়া রাত্রি শেষ প্রহরে পার্ব্বত্য বসতির সন্নিকটে নিজ কুটীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে শাস্ত্র ও যোগ পদ্ধতির আলোচায় কয়েকদিন কাটিয়া গেলে, মহাত্মাজী একদিন বেণীমাধবকে সঙ্গে লইয়া তীর্থ পয্যটনে বাহির হইলেন।
নানাদেশ পর্য্যটন করিয়া তাঁহারা ক্রমে কানপুর শহরের অনতিদূরে গঙ্গাতীরবর্ত্তী বিঠৌর নামক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই স্থানে বহু সাধুসন্ন্যাসীর আস্তানা ছিল। মহাত্মাজী তথায় দেহ রক্ষা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া বেণীমাধবকে বলিলেন,“ বৎস, অনেকদিন হইয়া গিয়াছে সুতরাং এই জীর্ণশীর্ণ দেহভার বহন করিবার ইচ্ছা আর আমার নাই; বিশেষতঃ যে কর্ত্তব্য সমাপন করিবার জন্য এতদিন দেহ রাখিয়াছিলাম তাহা আমার শেষ হইয়াছে, এখন তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াইয়া অভীষ্ট পথে চলিতে পারিবে। তুমি আরও নানাতীর্থ ভ্রমণ করিবে। তোমার সঙ্গে ভ্রমণকালে রামেশ্বর ক্ষেত্রে একজন মহাত্মার সাক্ষাৎ হইবে। তাঁহার নিকট হইতে তোমার নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্পর্কে তুমি অনেক কিছু জানিতে পারিবে। তারপর উত্তরাখণ্ডে হিমালয় প্রদেশে একজন মহাপুরুষের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হইবে। তাঁহার নিকট হইতে যে জ্ঞান লাভ করিবে তাহাতে তোমার জীবনের একটা বিশেষ পরিবর্ত্তণ ঘটিবে। আমার জন্য কোনও রূপ শোক করিও না। আমার শরীর জরাজীর্ণ ও অপটু। ইহার ভার আর বহন করা আমি বৃথা মনে করি।”
এই বলিয়া প্রাণ প্রিয়তম বেণীমাধবকে আশীর্ব্বাদ ও স্নেহালিঙ্গন করিয়া তিনি গঙ্গাতীরে মহাপ্রস্থানের জন্য আসন করিয়া বসিলেন ও অন্যান্য মহাত্মাদিগকে ডাকাইয়া বেদোক্ত মহাবাক্য উচ্চারণ করিতে করিতে তনুত্যাগ করিলেন। সুধুগণ মহানন্দে এই ঋষিকল্প মহাপুরুষের সমাধি অনুষ্ঠানাদি কার্য্য সমাধা করিয়া ধন্য হইলেন। বেণীমাধব নিজেকে অসহায় ও নিরাশ্রিত মনে করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সমাগত সাধুগণ তাঁহাকে নানারূপ বুঝাইয়া আপনাদের কুটীরে লইয়া গেলেন। তথায় কিছুদিন থাকিয়া তিনি হতাশ মনে শূণ্যহৃদয়ে শ্রীগুরুর উপদেশ মত দক্ষিণে রামেশ্বর তীর্থাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
রামেশ্বর তীর্থে গুরু শ্রীশ্রীতৈলঙ্গস্বামী নিকট হতে বেণীমাধবের দীক্ষা গ্রহণ
বহুদেশ ও তীর্থস্থান দর্শন করিতে করিতে তিনি ধীরে ধীরে পায়ে হাঁটিয়া প্রায় ছয়মাস পর রামেশ্বর তীর্থে পৌঁছিলেন। তথায় সেই সময়ে একটি বড় রকমের মেলা হইতে ছিল। সেখানে বহু সাধু সন্ন্যাসীর সমাগম হইয়াছে এবং বহু পুণ্য প্রয়াসী গৃহস্থ স্ত্রী পুরুষ স্নান দান ও দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া উপস্থিত হইয়াছেন। মেলায় ঘুরিতে ঘুরিতে তাঁহার সহিত হঠাৎ এক মহাত্মার দেখা হইল। বেণীমাধব তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই কিন্তু স্বামীজি তাঁহাকে দেখিবামাত্রই ইঙ্গিত করিয়া নিকটে ডাকিলেন।
বেণীমাধব স্বামীজীর নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাঁহাকে বসিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে উভয়ের কথাবার্ত্তা আরম্ভ হইল। এই দিব্য জ্যোতিসম্পন্ন নবীন উদাসী যুবকটিকে স্বামীজীর সহিত আলাপ করিতে দেখিয়া বহুলোক আকৃষ্ট হইয়া সেখানে সমবেত হইল।
বেণীবাধব স্বামীজীর কথায় বুঝিলেন যে, তিনি তাঁহার হৃদয়ের আরাধ্য দেবতা শ্রীগুরু মহারাজের সহিত তাঁহার হিমালয় পার্ব্বত্য আশ্রমে অনেকদিন একসঙ্গে ছিলেন এবং তাঁর যখন প্রয়াগে জন্ম হয় তখন তিনি ও অন্য একজন মহাত্মা শ্রী গুরুজীর সহিত তাঁহাকে দেখিতে গিয়াছিলেন। বিঠৌরে তাঁহার দেহরক্ষা প্রভৃতি সমস্ত সংবাদই তিনি জানেন। তিনি আরও বলিলেন যে রামেশ্বর ক্ষেত্রে বেণীমাধবকে দীক্ষিত করিবার জন্যই তিনি অপেক্ষা করিতেছেন।
স্বামীজী একটি শুভদিন স্থির করিয়া নাপিত ডাকাইয়া বেণীমাধবের মস্তক মুন্ডন করিয়া রামেশ্বর তীর্থক্ষেত্রে সম্মিলিত জ্ঞানবৃদ্ধ সিদ্ধ মহাত্মাদের সম্মূখে যথারীতি তাঁহাকে সন্ন্যাস দীক্ষা দান করিলেন। ইনিই লোক প্রসিদ্ধ পরমপূজ্যপাদ সিদ্ধ জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ শ্রীশ্রীতৈলঙ্গস্বামী নামে পরিচিত। এখন বেণীমাধবের নামকরণ হইল ত্রিপুর্লিঙ্গ। তিনি ত্রিদণ্ড ধারণ করিয়া কায়মনোবাক্যে সংযম সহকারে কিছুদিন তৈলঙ্গ স্বামীজীর সহিত তথায় বাস ও নানা বিষয়ে উপদেশ গ্রহণ করিলেন। রুদ্রের ন্যায় তেজস্বী ও সৌম্য মূর্ত্তি সম্পন্ন দেখিয়া তথায় অন্যান্য মহাত্মাগণ তাঁহাকে রুদ্র ত্রিদণ্ডী বলিয়া সম্বোধন করিতেন। ত্রিপুর্লিঙ্গ শুনিতে পাইলেন যে তাঁহার গুরুজী দেহত্যাগের কিছু কাল পূর্ব্বেই তৈলঙ্গস্বামীজীর উপর তাঁহার সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া গিয়াছিলেন। মেলা অন্তে প্রত্যেকেই নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরিয়া যাইতে লাগিল। নির্দ্দিষ্ট বাসস্থানহীন ত্রিপুর্লিঙ্গ এখন তৈলঙ্গস্বামীজীর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া তীর্থ পর্য্যটনের অভিপ্রায়ে বাহির হইয়া পড়িলেন।
ত্রিপুর্লিঙ্গ সরস্বতীর দক্ষিণদেশে ভ্রমণ
ত্রিপুর্লিঙ্গ রামেশ্বর তীর্থ হইতে দ্রাবিড় দেশস্থ তীর্থসমূহ ভ্রমণ করিয়া ক্রমে ক্রমে কন্যাকুমারীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। তথা হইতে সমুদ্রের উপকূলবর্ত্তী দেশসমূহ পরিভ্রমণ করিয়া কখনও পদব্রজে কোথাও বা নৌকাযোগে চলিতে চলিতে মালাবার প্রদেশে আসিয়া পৌঁছিলেন। তাঁহার অতি সুন্দর শারীরিক গঠন ও গৌরবর্ণ কান্তি এবং অলৌকিক জ্যোতি সম্পন্ন আকৃতি দেখিয়া তথাকার কোন রাজা আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে সেখানে কিছুদিন থাকিবার জন্য ভক্তিভরে বিনীতভাবে অনুরোধ করায় ত্রিপুর্লিঙ্গ কয়েকদিন সেখানে বাস করেন। রাজা তাঁহার সেবা শুশ্রƒষার নানাপ্রকার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিলেন কিন্তু ইহাতে সন্ন্যাসধর্ম্মের ক্ষতি হইবে মনে করিয়া তিনি ঐ স্থান পরিত্যাগ করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। রাজা তাঁহাকে আরও কিছুদিন থাকিতে অনুরোধ করিলেন। তাঁহার অনুরোধে সেখানে আরও সপ্তাহকাল থাকিয়া রাজাকে ধর্ম্ম ও রাজনীতি সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া রাজপ্রাসাদ হইতে তিনি বাহির হইয়া পড়িলেন।
আপন মনে আত্মানন্দে বিভোর হইয়া ভ্রমণ করিতে করিতে ত্রিপুর্লিঙ্গ ধীরে ধীরে কিষ্কিন্ধ্যা পম্পাসরোবরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হায়দরাবাদে নিজাম বাহাদুরের দেওয়ান সিংহের ভবনে দুই চারি দিন থাকিয়া সেখান হইতে হাঁটিয়া তিনি তুঙ্গভদ্রা নদীতীরবর্ত্তী হরিহরপুরে আসিলেন এবং তথা হইতে বহু বন-জঙ্গলপূর্ণ দেশের মধ্য দিয়া অতি কষ্টে পুণা সেতারায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তথায় কয়েকদিন বিশ্রাম করিয়া তিনি মুম্বাজী (বর্ত্তমান বোম্বাই) অভিমূখে রওনা হইলেন। অতি দুর্গম পর্ব্বত অতিক্রম করিয়া মুম্বাজী আসিতে তাঁহাকে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল এবং সময়ও অনেক লাগিয়াছিল। পার্ব্বত্য অঞ্চলে পথ চলিবার সময় প্রায় সপ্তাহকাল তিনি অনাহারে ছিলেন। এই সময় তিনি বনঘুটে ভস্ম করিয়া জলে গুলিয়া তাহাই পান করিতেন এবং কখনও কখনও বট এবং ডুমুর ফল খাইতেন। মুম্বাজী বন্দর হইতে তিনি এ্যম্বকেশ্বরে আসিলেন এবং কিছুদিন সেখানে নর্ম্মদাতীরে বাস করা স্থির করিলেন।
ঐ সময়ে তিনি প্রাণে কোনরূপ শান্তিই পাইতেছিলেন না। নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া তাঁহার মনটাকে যেন মাতাল করিয়া তুলিতেছিল। ভগবান সাকার কি নিরাকার সে সম্বদ্ধে তিনি তখন পর্যন্তও কিছু সিদ্ধান্ত করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তিনি প্রত্যক্ষভাবে কিছু অনুভব না করা পর্য্যন্ত সহজে কিছু স্বীকার করিবার পাত্র নহেন। তিনি নর্ম্মদার তীর ধরিয়া চলিতে লাগিলেন এবং নানারূপ চিন্তা আসিয়া তাঁহার মনকে জুড়িয়া বসিল। তবে কি দেবদেবী কিছুই নাই- নিরাকার সম্বদ্ধেই বা প্রত্যক্ষ অনুভবযোগ্য প্রমাণ কি আছে। ব্যবহারিক জগতের ভিতর দিয়া তাঁহার ন্যায় তীব্র বৈরাগ্যবান বিচারশীল পুরুষ এই কয়মাস ভ্রমণ করিয়া যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন তাহাতে অবশ্য এক অজ্ঞাত শক্তি সম্বন্ধে মনে কিছু কিছু বিশ্বাস জন্মিয়াছে।
স্বামী ত্রিপুর্লিঙ্গ-এর মহাত্মা জ্যোতিস্বামীর সহিত সাক্ষাৎ
ত্রিপুর্লিঙ্গ এ্যম্বকেশ্বর হইতে নর্ম্মদার তীর ধরিয়া চলিতে চলিতে কোন একস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন তথায় বহু গরীব দুঃখী এবং সাধু সন্ন্যাসী বসিয়া আছে। তিনি অলসভাবে দাঁড়াইয়া এই জনতা দেখিতেছেন, এমন সময় সহসা তাহাদের ভোজনের জন্য সেখানে নানারূপ খাদ্য সামগ্রী আসিয়া উপস্থিত হইল। কেবলমাত্র ত্রিপুর্লিঙ্গই কিছু গ্রহণ করিলেন না। তিনি এই সব জিনিস কোথা হইতে আসিল, কে দিল তাহা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া জানিলেন যে, জ্যোতিস্বামী নামে এক সিদ্ধ মহাত্মা এখানে আছেন, তাঁহার বাসস্থান নর্ম্মদাতীরে একটী গাছ তলায়- তাঁহার একমাত্র সম্বল ভিক্ষার ঝুলির ন্যায় একটী থলে ঐ গাছেই ঝুলান থাকে। আশ্চর্য্যরে বিষয় এই যে যিনি যাহা খাইতে চান ঝোলায় হাত দিয়া তিনি সেই জিনিসই তাহাকে বাহির করিয়া দেন।
সাধু সজ্জন অতিথি অভ্যাগত, গরীব দুঃখী প্রত্যেকেই প্রতিদিন তাঁহার নিকট খাদ্য সামগ্রী পাইয়া থাকে। জ্যোতিস্বামীর কোনরূপ আশ্রম বা আস্তানা নাই। ঐ গাছ তলায়ই তিনি বরাবর বাস করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার বয়স যে কত হইয়াছে কেহই বলিতে পারে না। এই মহাত্মাকে দেখিবার জন্য ত্রিপুর্লিঙ্গের অত্যন্ত কৌতুহল জন্মিল। তিনি গাছতলায় জ্যোতিস্বামীর নিকট গিয়া দেখিলেন অতি বৃদ্ধ স্থবির এক মহাত্মা-এত বৃদ্ধ যে তাঁহার চক্ষুর পাতা ও গাত্রচর্ম্ম লোল হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে। তাঁহার দাঁড়ি, গোঁফ ও শরীরের রোমরাজি সমস্তই শুভ্র। এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি শরীরের বেশ শক্তি রাখেন এবং অনায়াসে হাঁটিয়া চলাফেরা করিতে পারেন। তাঁহার দৃষ্টিশক্তিও বেশ আছে। ত্রিপুর্লিঙ্গ সমস্তই অতি সতর্ক ভাবে লক্ষ্য করিলেন। কিছুই তাঁহার দৃষ্টি এড়াইল না। ভাবিতে লাগিলেন, এতটা কষ্ট সহ্য করিয়াও এই বৃদ্ধ বয়সে এই গাছতলায় পড়িয়া থাকা সত্ত্বেও কি সুন্দর ইহার স্বাস্থ্য ও যোগক্রিয়া গঠিত শরীর! তিনি আরও ভাবিলেন যোগাভ্যাস দ্বারা শরীর গঠন ও অলৌকিক শক্তিলাভ করিতে হইবে নতুবা জীবনই বৃথা। কিছুক্ষণ জ্যোতিস্বামীর নিকট বসিয়া তিনি নানাকথা চিন্তা করিতেছেন এমন সময় বৃদ্ধ মহাত্মা একবার তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিলেন। তিনিও সচকিত চিত্তে মহাত্মাকে সম্মান প্রদর্শন করিয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন।
জ্যোতিস্বামী তাঁহাকে বলিলেন,“তুমি এখানে তিন চারিদিন থাকিয়া যাও।” এই বলিয়া ঝোলায় হাত দিয়া তিনি কিছু লাড়– ও মালপুয়া বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলেন এবং নর্ম্মদার তীরে বসিয়া তাঁহাকে খাইতে বলিলেন। ত্রিপুর্লিঙ্গ তৃপ্তির সহিত আহার করিলেন। এমন সুস্বাদু টাটকা জিনিস কিভাবে কোথা হইতে পাইলেন, ইহার অনুসন্ধান করিয়া সব খবর লইতে হইবে ভাবিয়া তিনি জ্যোতিস্বামীর অতি কাছে গিয়া বসিলেন।
ত্রিপুর্লিঙ্গ কিছু না বলিতেই মহাত্মা জ্যোতিস্বামী বলিলেন, “নিজে প্রস্তুত হও। সব বিষয় তোমার সম্মুখে আপনিই প্রকাশিত হইবে, কিছুই অজানা থাকিবে না। প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানের জন্য সংকল্প করিয়া তুমি যে পথ ধরিয়াছ সেই পথে একাগ্রমনে চলিয়া অভীষ্ট লাভ করিলে তোমার কিছুই অজানা থাকিবে না। নিজের মধ্যেই তুমি সারা দুনিয়ার তত্ত্ব খুঁজিয়া পাইবে, তখন তোমার মনের ধাঁধাঁ ঘুচিবে, সমস্ত সংশয় দূর হইবে। এ সমস্ত অলৌকিক কাজের মধ্যে আশ্চর্য্য হইবার কিছুই নাই। সেই অব্যক্ত মহাশক্তি সম্বন্ধে লোকের বিশ্বাস জন্মাইবার জন্যই এইরূপ ক্ষমতা দেখানো দরকার হয় মাত্র।”
এই মহাত্মা একজন সর্ব্বজ্ঞ ও জ্ঞানী মহাপুরুষ জানিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গ চমৎকৃত হইলেন। তখন তিনি মহাত্মাজীর নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া তথায় কিছুদিন থাকিয়া তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। মহাত্মাও এই প্রস্তাব সানন্দে অনুমোদন করিলেন। মহাত্মাজীর কয়েকটি সেবক ও ভক্ত ছিল। তিনি তাঁহাদের ডাকিয়া নর্ম্মদা তীরে পাহাড়ের গায়ে একটি গুহায় ত্রিপুর্লিঙ্গের থাকিবার সব বন্দোবস্ত করিয়া দিতে আদেশ করিলেন। এইখানে থাকিয়া অধিকাংশ সময়েই তিনি ঐ মহাত্মার উপদেশ গ্রহণ, বিচার ও শাস্ত্রলাপ এবং কিছু যোগানুসন্ধানের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
একদিন গভীর রাত্রিতে জ্যোতিস্বামী ত্রিপুর্লিঙ্গের গুহাদ্বারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তিনি গুহার দরজায় যোগাসনে উপবিষ্ট হইয়া নর্ম্মদার দিকে তাকাইয়া আছেন কিন্তু তাঁহার শরীরের স্পন্দন, চক্ষুর পলক ও শ্বাসপ্রশ্বাস স্থির- ত্রিপুর্লিঙ্গ গভীর ধ্যানমগ্ন। স্বামীজী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিতেছেন এমন সময় ধ্যান ভঙ্গ হইতেই সম্মুখে তাঁহাকে দেখিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গ তাঁহার পাদ বন্দনা করিয়া মৌনভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। জ্যোতিস্বামী তাঁহাকে কহিলেন, “বৎস, তোমার জীবনের বহু কাজ বাকী আছে, তুমি যে মহাপুরুষের আশ্রয়ে ছিলে তিনি যে একজন ত্রিকালজ্ঞ ঋষিতুল্য ব্যক্তি ছিলেন তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। কালে তুমিও যে একজন জ্ঞানী মহাত্মা হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। তোমার সব বিষয়ে পূর্ণতা লাভ এখানে হইবে না- তুমি আমার নিকট হইতে বিরজা হোম করিয়া ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করিয়া যদি আনন্দ লাভ কর তবেই তোমার চিত্তের প্রসন্নতা ও শান্তি লাভ হইবে। পরে ধীরে ধীরে উক্ত আত্মজ্যোতি স্ব স্ব রূপে স্থিতি লাভ করিবে। আজ প্রভাতেই হোমানুষ্ঠান হইবে তুমি প্রত্যুষে স্নান করিয়া আমার নিকট আসিও।”
এই বলিয়া মহাত্মা চলিয়া গেলেন। ত্রিপুর্লিঙ্গের নিকট সমস্ত ব্যাপার যেন স্বপ্নবৎ বোধ হইতে লাগিল।
এই বলিয়া মহাত্মা চলিয়া গেলেন। ত্রিপুর্লিঙ্গের নিকট সমস্ত ব্যাপার যেন স্বপ্নবৎ বোধ হইতে লাগিল। প্রভাতে স্নান করিয়া স্বামীজীর আদেশমত তিনি তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। স্বামীজী একজন ভক্তকে হোমদ্রব্যাদি আনিতে বলিলেন। যথাসময়ে হোম আরম্ভ হইল। সমস্ত দিবসব্যাপী হোম ক্রিয়া চলিল। রাত্রে তিনি ত্রিপুর্লিঙ্গকে বিরজার অন্যান্য ক্রিয়ার উপদেশ দিলেন এবং বিরজা হবণ আরম্ভ হইল। ভোর হইবার অল্প আগে তিনি পূর্ণাহুতি দিলেন। হোমকু- হইতে এক অপূর্ব্ব দিব্য জ্যোতির্ম্ময় শিখা প্রতীপ্ত হইয়া উঠিল। দেখিলে, যেন চক্ষু ঝলসিয়া যায়।
ত্রিপুর্লিঙ্গের চক্ষু মুদিত হইয়া আসিল-ঐ সময়ে কিভাবে তিনি ছিলেন তাঁহার কিছুই মনে নাই, কেবল মনে পড়ে চক্ষু মুদিবার পর নিজের ভিতরে এক উদ্দীপ্ত তেজ অনুভব করিলেন ও সঙ্গে সঙ্গে যেন এক অভূতপূর্ব্ব মহানন্দ রসে মগ্ন হইয়া পড়িলেন। বহুক্ষণ এইভাবে কটিয়া গেলে পরে যখন তাঁহার হুঁস্ হইল তখন ভিতরে বাহিরে সর্ব্বত্রই তিনি এক আনন্দ রাজ্যের অস্তিত্ব অনুভব করিতে লাগিলেন। তিনি মহাত্মাকে প্রণাম করিলেন। মহাত্মা তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া স্নেহভরে বলিলেন, “বৎস, যাহা কিছু প্রত্যক্ষ করিলে সেই আত্মজ্যোতির তত্ত্বানুসন্ধান করিয়া তাহাতে স্থিতপ্রজ্ঞ হও শোক দুঃখের অতীত হও।”
উত্তরাখণ্ডে পথে স্ত্রী সহিত সাক্ষাৎ
আরও দুই চারিদিন সেখানে কাটাইয়া স্বামীজীর আদেশানুসারে নর্ম্মদা মাইকে প্রণাম করিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গ উত্তরাখ-াভিমুখে যাত্রা করিলেন। আত্মবিষয়ে মনন নিদিধ্যাসন করিতে করিতে আনন্দচিত্তে দেশ দেশান্তর, পর্ব্বত,বন, নদ-নদী অতিক্রম করিয়া ওঁকারনাথ ও উজ্জিনীতে মহাকালেশ্বর দর্শন করিয়া তিনি কানপুরে আসিয়া পৌঁছিলেন। চিরপরিচিত শ্রীগুরুজীর পবিত্র সমাধিস্থান দর্শন করিতে বিঠৌরে গেলেন। তিনি অনেকক্ষণ সাশ্রুলোচনে মৌনভাবে সমাধিস্থানে কাটাইয়া দিলেন। মহাত্মাজীর বহু স্মৃতি তাঁহার মনে পড়িয়া তাঁহার মনকে চঞ্চল করিয়া তুলিল। হৃদয় যেন শতধা বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। আজ আবার নূতন করিয়া সেই সমাধি দিবসের ন্যায় নিজকে তিনি অসহায় বোধ করিতে লাগিলেন। আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা মনে হওয়ায় তিনি কিছুক্ষণ হৃতচৈতন্য অবস্থায় রহিলেন। এমন সময় কোথা হইতে যেন আকাশবাণী শুনিতে পাইলেন, “বেণী স্থির হও। ভয় কি! আমি তো তোমার সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছি।” সেই চির পরিচিত কন্ঠস্বর শুনিয়া মনে সাহস সঞ্চয় করিয়া তিনি সেখান হইতে উঠিয়া পড়িলেন এবং চারিদিকে তাকাইতে লাগিলেন কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার হৃদয় ভক্তি শ্রদ্ধায় ভরিয়া উঠিল। এমন সময় জনৈক সন্ন্যাসী আসিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গকে আপন কুটিরে লইয়া গেলেন। সেখানে একদিন থাকিয়া তিনি স্থানান্তরে রওনা হইলেন।
পথিমধ্যে তাঁহার একটি বাল্য বন্ধুর সহিত দেখা হইল। বন্ধুটী বেণীমাধবকে বহুদিন পর দেখিয়া আনন্দে অধীর হইল এবং তাঁহাকে তাহার বাড়ীতে যাইবার জন্য এরূপ ভাবে অনুরোধ করিল যে ত্রিপুর্লিঙ্গ তাহা এড়াইতে পারিলেন না। উক্ত বন্ধুটীর বাড়ী এবং ত্রিপুর্লিঙ্গের শ্বশুরালয় এক গ্রামেই ছিল। তাঁহার নিকট হইতে কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানিলেন যে তাঁহার পিতামাতা কেহই আর জীবিত নাই। বন্ধুটীর গৃহে পৌঁছিয়া তিনি শুনিলেন যে, তাঁহার পুত্রের শুভ উপনয়ন সংস্কার সেই দিনই তাঁহার শ্বশুরালয়ে সম্পন্ন হইতেছে।
উপনয়ন উৎসবে গঙ্গাদেবী কি যেন একটা বিরাট অভাব বোধ করিতেছিলেন। একমাত্র পুত্রের উপনয়ন সংস্কার কিন্তু প্রিয়তম স্বামী নিরুদ্দেশ তাই থাকিয়া থাকিয়া সতীর পবিত্র হৃদয় কাঁদিয়া উঠিতেছিল। তিনি মনে মনে ভাবিতেছিলেন আজ তাঁহার প্রাণ-প্রিয়তম পতি সেখানে উপস্থিত থাকিলে কত আনন্দই না তাঁহার হইত। এক এক সময় আনন্দে তাঁহার প্রাণ মাতিয়া উঠিতেছিল আবার পর মূহুর্ত্তেই বুক ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল। এমন সময় খবর পাইলেন তাঁহার চিরঅরাধ্য দেবতা দ্বারে উপস্থিত। গঙ্গাদেবীর প্রাণ আনন্দে নাচিয়া উঠিল। তাঁহার প্রাণের ভিতর দিয়া বিদ্যুতের ন্যায় এক আনন্দচ্ছটা ঝলসিয়া গেল কিন্তু তিনি তখনই আত্মসংবরণ করিলেন কারণ স্বামী সকাশে গেলে স্বামীর সন্ন্যাস ধর্ম্মের ত্রুটী ঘটিতে পারে।
উৎসব শেষে ত্রিপুর্লিঙ্গ স্ত্রীকে ডাকিয়া সংসারের অনিত্যতা সম্বন্ধে নানাবিধ উপদেশ দিয়া বিদায় লইলেন। আরও কিছুদিন থাকিবার জন্য তাঁহার বাল্যবন্ধু বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিল কিন্তু তিনি তাহা শুনিলেন না। যাইবার সময় বন্ধুটীকে বলিয়া গেলেন যে সপ্তাহকাল পরেই পুত্রটীর মৃত্যু ঘটিতে পারে কাজেই এই সময় তাঁহার পক্ষে সেখানে থাকা ঠিক হইবে না। ইহা বলিয়াই তিনি প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য সপ্তাহকাল পরেই পুত্রটী কালগ্রাসে পতিত হইল। গঙ্গাদেবী পুত্রের মৃত্যুতে কিন্তু ক্ষণকালের জন্যও মোহাভিভূত হইলেন না। স্বামীর উপদেশ ও শ্রীপদ ধ্যান করিয়া মনকে সান্তনা দিয়া তিনি সহজেই পুত্রশোক সম্বরণ করিতে পারিলেন।
ত্রিপুর্লিঙ্গ বহু দেশ পর্য্যটন করিয়া কিছুদিনের মধ্যে বহেরাজ আসিয়া পৌঁছিলেন- ইহা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। কয়েক ঘর বসতি লইয়া লতাপাতা ঘেরা এই ক্ষুদ্র গ্রামখানিতে পরমানন্দ নামে এক অঘোরপন্থি সাধুর সহিত তাঁহার দেখা হইল। ইহার বয়স খুব বেশী নহে, কিন্তু অল্প বয়সেই সাধনায় তিনি বেশ উন্নতি লাভ করিয়াছিলেন। তিনি ত্রিপুর্লিঙ্গের দিব্য শান্ত সৌম্যমূর্ত্তি দেখিয়া তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইলেন। উগ্র তপস্বী হইলেও ত্রিপুর্লিঙ্গের শান্ত শিষ্ট আলাপে উভয়ের মধ্যে বেশ একটু প্রীতির ভাবও জন্মিল। আজ কাল করিয়া তিনি পরমানন্দের সঙ্গে পক্ষাধিক কাল রহিয়া গেলেন। পরমানন্দের সাধন প্রণালী তাঁহার আদৌ পছন্দ হয় নাই কিন্তু তাঁহার বৈরাগ্য প্রভাব ও বেদান্ত বাক্যগুলি ব্রহ্মানন্দদায়ক হইয়াছিল। বহুকাল পরে বঙ্গদেশে সাধন-সিদ্ধ এই পরমানন্দের সহিত পুনরায় তাঁহার দেখা ও একত্র বাস প্রসঙ্গ পরে বর্ণিত হইয়াছে।
হিমালয় অভিমুখে স্বামী শ্রী শ্রীমৎ ত্রিপুর্লিঙ্গ সরস্বতী
তিনি বহেরাজ হইতে রওয়না হইয়া দুর্গম পার্ব্বত্য স্থান সমূহ দুঃসাহসের সহিত অতিক্রম করিয়া বৈরাগ্যভূমি হিমাচলের মধ্য দিয়া তিব্বতের সীমান্তে তুহুঁ নামক এক পল্লীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তথায় দুই এক দিন বিশ্রামের পর তিনি আরও উপরের দিকে উঠিতে লাগিলেন। এই সময়ে তাঁহাকে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। এমন কি একদিন ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইয়া পথিমধ্যে তিনি মৃতপ্রায় পর্য্যন্ত হইয়াছিলেন। নিকটে কোথাও কোন বসতিও ছিল না। দৈবক্রমে এক রাখাল বালক এইরূপ অসহায় অবস্থায় তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া একটী ভেড়ীর দুধ দোহন করিয়া তাঁহাকে পান করিতে দেয়। উহা পান করিয়াই এই জনপ্রাণীহীন স্থানে তাঁহার জীবন রক্ষা পায়।
তথা হইতে হাঁটিয়া তিনি কোট মেরুঙ্গা নামক এক স্থানে উপস্থিত হন। তথাকার কোন এক পাহাড়ী মহাজন তাঁহাকে সাদরে নিজ বাটীতে লইয়া যায়। তথায় দিন দুই বিশ্রামান্তে পুনরায় তিনি পাহাড়ী পথ ধরিয়া যাত্রা করেন। এবার মৃত্যুপণ করিয়া তিনি দুর্গম পার্ব্বত্য পথ ধরিয়া ক্রমাগত চলিতে লাগিলেন। কোথায় যাইতেছেন কিছুই ঠিক নাই। এ সময় কোনদিন তিনি পক্ক বটফল অথবা পক্ক গুলোড়(ডুমুরফল) আহার করিতেন। কোনও দিন আবার ঘুঁটের ছাই ঝরণার জলে গুলিয়া তাহাই পান করিতেন। কোনদিন পাহাড়ী পল্লীতে দুধছাতু আহার মিলিত। এইরূপে কখনও অনশনে কখনও বা অর্দ্ধাশনে কোথাও বা বনমধ্যে ক্ষুদ্র বস্তিতে ভুঁড়িভোজনে তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল।
জীবনের মায়া তাঁহার আর নাই। তিনি ক্রমাগতই উপরের দিকে উঠিতেছেন। পথিমধ্যে এক দিন এক গভীর ঝরণার পাশে তিনি একটী পাহাড়ী লোককে দেখিতে পাইলেন। সে তাঁহাকে সাদরে সম্ভাষণ করিয়া তাঁহাকে তাহার কাজে সাহায্য করিতে বলিল। ত্রিপুর্লিঙ্গ তাহার কাজে সাহায্য করিতে গিয়া দেখিলেন, উক্ত ব্যক্তি এক আদ্ভূত প্রণালীতে স্বর্ণ প্রস্তুত করিল। ইহা সত্য, মিথ্যা বা ভেল্কি অথবা মায়ার ফাঁকি কিছুই তিনি বুঝিতে পারিলেন না। সাময়িক লোভ মত্ততা ত্রিপুর্লিঙ্গকেও পাইয়া বসিল। কিন্তু কিছুকাল উহার সহিত ঘুরিয়া ফিরিয়া তাঁহার একাজ ভাল লাগিল না। তিনি একদিন তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া পুনরায় পথ চলিতে আরম্ভ করিলেন।
এইরূপে কিছুদিন চলিবার পর তিনি তিব্বতের কোন এক কোন এক গ্রামের প্রান্তভাগে আসিয়া পৌঁছিলেন। সেখানে তিনি এক বৃক্ষতলে বসিয়া আছেন, দিবা শেষ প্রহর আগতপ্রায়, কিছু আগুনের দরকার তাই তিনি গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়া এক গৃহস্থের কুটীরে গিয়া আগুন চাহিলেন। গৃহস্বামী বাড়ী ছিলেন না। তাহার অষ্টম বর্ষীয়া বালিকা কণ্যা সাধুকে আগুন চাহিতে দেখিয়া ক্রদ্ধ হইয়া তাঁহাকে কি যেন বলিতে লাগিল। ত্রিপুর্লিঙ্গ মেয়েটীর কথা কিছুই বুঝিলেন না কারণ ঐ ভাষা তাঁহার জানা নাই, এমন সময় গৃহস্থের পতœী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে ত্রিপুর্লিঙ্গকে বুঝাইয়া দিল যে, ‘কন্যা বলিতেছে সাধু ব্রাহ্মণ কেন আগুণ সংগ্রহের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরিবে! অগ্নিদেবতাকে সর্ব্বদাই তাঁহারা ইচ্ছামত আবাহন করিতে পারেন। আপনি ইহার প্রতি ক্রুদ্ধ হইবেন না। আমি এখনই আগুণ দিতেছি।’
এই বলিয়া কয়েক টুকরা কাঠ কন্যার হাতে দিয়া সে বলিল, “সাধুকে আগুন দাও।” কন্যাটী তখনই কাঠের উপর অগ্নি দেবতাকে মন্ত্র উচ্চারণ পূর্ব্বক আবাহন করিয়া ফু দিতে লাগিল এবং অল্পক্ষণ মধ্যেই আগুণ জ্বলিয়া উঠিল। বালিকা ত্রিপুর্লিঙ্গের সম্মুখে সেই আগুন রাখিয়া দিল। ত্রিপুর্লিঙ্গ ব্যাপার দেখিয়া বিস্মত হইলেন। ভাবিলেন, একি আশ্চর্য্য ব্যাপার! একটী ক্ষুদ্র বালিকা! তাহার একি অদ্ভূত ক্ষমতা! তিনি এ কোন্ মায়ার রাজ্যে আসিয়া পড়িলেন! গৃহস্থ পতœীকে ত্রিপুর্লিঙ্গ কন্যার পিতা কোথায় জিজ্ঞাসা করিলেন এবং তাহার সহিত সাক্ষাত করিতে চাহিলেন। কন্যাটীর মা বলিল তিনি বাড়ী নাই। সন্ধ্যায় ফিরিবেন। সুতরাং ত্রিপুর্লিঙ্গ তাঁহার সহিত সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে গৃহস্বামী বাড়ী ফিরিলেন। তাহার গলায় পৈতা, কাঁধে কোদালি ও পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ধূলাকাদা মাখা। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র গৃহিণী আসিয়া কাঁধ হইতে কোদালি নামাইয়া লইলেন, তারপর জল দিয়া নিজ হাতে তাহার পায়ের কাদা ধুইয়া কাপড় দিয়া মুছিয়া দিলেন। ব্রাহ্মণ ঘরের দাওয়ায় বিশ্রাম করিতে বসিলেন। গৃহে এক অভুক্ত সাধু অতিথি উপস্থিত এ কথা স্ত্রী স্বামীকে জানাইলেন।
অতিথি গৃহে উপস্থিত শুনিয়া কালবিলম্ব না করিয়া ব্রাহ্মণ ত্রিপুর্লিঙ্গের নিকট আসিয়া বলিলেন, “ মহাত্মন্, আপনি অভুক্ত অবস্থায় আমার গৃহে অপেক্ষা করিতেছেন, ইহা গৃহস্থের পক্ষে বড়ই অকল্যাণকর, ইহাতে গৃহস্থের পাপ হয়, আপনি জানিয়া শুনিয়াও কেন আমাদিগকে অপরাধী করিতেছেন। আমাদের যদি কিছু ক্রটী হইয়া থাকে তবে তাহা ক্ষমা করিয়া পানআহার ভিক্ষা গ্রহণ করুন। ত্রিপুর্লিঙ্গ বলিলেন, “বাবা ইহাতে তোমার কোনই অমঙ্গল হইবে না, পাপ তোমাকে স্পর্শ করিতে পারে না। আমি নিজ স্বার্থেই এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। ইহাতে তোমার কোনই অপরাধ হয় নাই। আজ তোমার কন্যা আমাকে যে আলৌকিক ঘটনা দেখাইয়াছে ইহার সত্য মর্ম্ম আমাকে সরল ভাবে বল ইহাই আমার অনুরোধ। তোমার কাছে ইহা জানিবার জন্যই আমি এত সময় ধরিয়া তোমার গৃহে অপেক্ষা করিতেছি।”
ব্রাহ্মণ স্ত্রী নিকট সমস্ত ঘটনা শুনিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “ মহাতœন্, পূর্ব্ব দেশীয় ও সমতল অঞ্চলের ব্রাহ্মণগণ অনুশীলনের অভাবে তাহাদের নিজ শক্তি সমস্তই হারাইয়া ফেলিয়াছে বলিয়া তাহারা এইরূপে অগ্নি আবাহন করাকে অজ্ঞানতাবশতঃ ইহাকে বুজরুকি মনে করে। যদি কেহ কখনও এইরূপ শক্তির অধিকারী হয় তবে সে উহা সকলকে দেখাইয়া যশ ও অর্থ উপার্জ্জন করিবার সুযোগ গ্রহণ করে। ইহার মধ্যে আপনাকে শিখাইবার কিছুই নাই। যাহা হউক আপনি ভিক্ষা গ্রহণ করুন তারপর ভোজনান্তে আপনার সহিত আমি এ বিষয়ে আলোচনা করিব। অতিথি সন্ন্যাসী গৃহে অভূক্ত থাকিলে আমি কি করিয়া আহার করিতে পারি।”
ত্রিপুর্লিঙ্গ বলিলেন, “আমি তোমাদের হাতে খাইতে ইচ্ছা করি না।” শুনিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন, “ইহাতে কোন দোষ নাই তবুও যদি আপনার আপত্তি থাকে তবে অগ্নিদ্বারা উহা শুদ্ধ করিয়া নিন্।” তিনি স্ত্রীকে খাদ্যদ্রব্য আনিতে আদেশ করিলেন। স্ত্রী খাদ্য লইয়া আসিলে ব্রাহ্মণ জলপাত্র হাতে লইয়া মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে মাটীতে ছিটাইয়া দিবামাত্রই মাটি হইতে ঈষৎ নীলাভ অগ্নিশিখা প্রকাশ পাইতে লাগিল। ব্রাহ্মণ ঐ আগুনে ত্রিপুর্লিঙ্গকে খাদ্য শুদ্ধ করিয়া লইতে বলিলেন। অল্পক্ষণ মধ্যেই আহার্য্য দ্রব্য গরম হইল দেখিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গ ততোধিক বিষ্মিত হইলেন। যাহা হউক তিনি ঐ খাদ্য সানন্দে ভোজন করিয়া পরম তৃপ্তি লাভ করিলেন। (পূর্ব্বে তুঙ্গনাথের ভোগের এক মণ আটার রুটির পি-টী ঠিক এইভাবে অগ্নি পক্ক হইত)।
ইহার পর ব্রাহ্মণের সলিত অনেকক্ষণ তাঁহার আলাপাদি হইল। ব্রাহ্মণ তাঁহাকে একটী ঘরে লইয়া গেলেন, ঘরটী তালপত্র ও তুলট কাগজে লিখিত অতি প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থরাজিতে পরিপূর্ণ। এই সমস্ত গ্রন্থ হইতে তিনি জ্যোতিষী তন্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্রীয় দুই একখানা পুস্তক বাহির করিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গকে পড়িয়া শুনাইলেন। ব্রাহ্মণ বলিলেন যে, কোনও গুপ্ত বিদ্যা পরদেশীবাসীকে তাহারা শিক্ষা দেন না, যদি তিনি(ত্রিপুর্লিঙ্গ) দেশে না ফেরেন এবং গৃহস্থাশ্রমী হইয়া তথায় বাস করেন তবে যে কোনও বিদ্যা তাঁহাকে শিখাইতে তিনি প্রস্তুত আছেন। ত্রিপুর্লিঙ্গ বুঝিলেন যে, ব্রহ্মণের মনে তাহার প্রতি সহানুভূতির সঞ্চার হইয়াছে। আরও দুই চার দিন কাটিয়া গেল। একদিন বৈকালে ব্রাহ্মণ প্রস্তাব করিলেন, “আপনি যদি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়া এখানে বসবাস করেন তবে যে বিদ্যা আমার যতটা চর্চ্চা করা আছে তাহা আমি আপনাকে শিক্ষা দিব। কন্যাকুব্জীয় আরও দু একজন ব্রাহ্মণ এখানে বিবাহাদি করিয়া বাস করিতেছেন।”
ত্রিপর্লিঙ্গ কিছুকাল মৌন থাকিয়া ব্রাহ্মণের নিকট নিজ জীবনের সমস্ত ঘটনা অকপটে ব্যক্ত করিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁহার সত্যকথা, বৈরাগ্য ও সাধুজনোচিত আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, “ধন্যভাগ ঈশ্বরানুগ্রহে আপনার অভিলাষ পূর্ণ হউক। আমি মোহাচ্ছন্ন হইয়া ¯েœহবশে আপনাকে গৃহে রাখিতে চাহিয়াছিলাম। আপনি আমার এইরূপ প্রস্তাবে মনক্ষুন্ন হইবেন না। আপনার সরলতায় আমি খুব আনন্দ পাইলাম, আপনি কিছুদিন এখানে থাকিয়া কোন কোন গুপ্ত শাস্ত্র আলোচনা করিতে যদি ইচ্ছা করেন তবে সন্তষ্টচিত্তে তাহা আমি আপনাকে শিখাইব।”
ত্রিপর্লিঙ্গ কিছুকাল মৌন থাকিয়া ব্রাহ্মণের নিকট নিজ জীবনের সমস্ত ঘটনা অকপটে ব্যক্ত করিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁহার সত্যকথা, বৈরাগ্য ও সাধুজনোচিত আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, “ধন্যভাগ ঈশ্বরানুগ্রহে আপনার অভিলাষ পূর্ণ হউক। আমি মোহাচ্ছন্ন হইয়া স্নেহবশে আপনাকে গৃহে রাখিতে চাহিয়াছিলাম। আপনি আমার এইরূপ প্রস্তাবে মনক্ষুন্ন হইবেন না। আপনার সরলতায় আমি খুব আনন্দ পাইলাম, আপনি কিছুদিন এখানে থাকিয়া কোন কোন গুপ্ত শাস্ত্র আলোচনা করিতে যদি ইচ্ছা করেন তবে সন্তষ্টচিত্তে তাহা আমি আপনাকে শিখাইব।”
ত্রিপুর্লিঙ্গ ব্রাহ্মণের এরূপ সদয় ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া তথায় থাকিতে স্বীকৃত হইলেন। সেখানে কিছুদিন থাকিয়া ত্রিপুর্লিঙ্গ ব্রাহ্মণের সহিত যথাযথ শাস্ত্রালোচনা করিলেন। তারপর এতদিন সেখান হইতে পথে বাহির হইয়া পড়িলেন।
কোথায় যাইতেছেন বা যাইবেন তাহার স্থিরতা নাই। ত্রিপুর্লিঙ্গ হিমালয়ের চিরতুষারম-িত পথে চলিতে চলিতে গঙ্গাতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পাহাড়ের গা দিয়া গঙ্গাদেবী নন্দনের বারতা লইয়া কুলু কুলু নাদে বহিয়া যাইতেছে। সেই করুণ গম্ভীর ক্লান্ত শব্দ পার্ব্বত্য প্রদেশে নিস্তব্ধতাকে যেন আরও ভীষণতর করিয়া তুলিতেছে। ত্রিপুর্লিঙ্গ শ্রান্ত দেহে একখ- পাথরের উপর বসিয়া পড়িলেন এবং কখন যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন জানিতে পারেন নাই। জাগিয়া দেখেন বেলা অতি অল্পই বাকী আছে। তাড়াতাড়ি উঠিয়া তিনি পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলেন, এমন সময় শুনিলেন, কে যেন ডাকিল, “ত্রিপুর্লিঙ্গ কোথায় যাইতেছ?”
তিনি চারিদিকে তাকাইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না, মনে করিলেন, ইহা হয়ত বায়ুর খেলা। পুনরায় তিনি পথ চলিতে লাগিলেন, আবার ঐরূপ ডাক শুনিয়া তিনি আশ্চর্য্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। অল্পক্ষণ পরেই দেখিতে পাইলেন পাহাড়ের উপর হইতে জটাজুট শোভিত শুভ্রকান্তি কে একজন নামিয়া আসিতেছেন। প্রথম দর্শনেই মনে হয় এক মহাপুরুষ। তিনি অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। মহাপুরুষ নিকটে আসিয়া সহাস্যবদনে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আমিই তোমাকে ডাকিয়াছি, তুমি আমাকেই স্মরণ করিতেছিলে, আমারই দর্শন লাভের জন্য তুমি ব্যাকুল হইয়াছিলে। আমি লামাস্বামী। তুমি ভৌতিক জাগতিক বিদ্যার জন্য পাগল হইয়া কেন বৃথা এতটা সময় নষ্ট করিলে? অনেক আগেই তোমার এখানে আসা উচিত ছিল। আমার গুহায় চল।”
এই বলিয়া তিনি আগে আগে পথ দেখাইয়া চলিলেন। পাহাড়ের উপরে এক সমতল স্থানে পাহাড়ের গায়ে গুহাটী নির্ম্মিত। গুহাটীর সম্মুখে সামান্য কিছু জায়গা সমতল ও ফল ফুল শোভত তরুরাজিদ্বারা সুশোভিত। পাশেই একটী ¯িœগ্ধ ঝরণার সুশীতল জলস্ত্রোতে প্রবাহাকারে বহিয়া চলিয়াছে। অদূরে নানা ভঙ্গীতে গিরিশৃঙ্গসমূহ তুষার-শুভ্র মস্তক উত্তোলন করিয়া দ-ায়মান। ত্রিপুর্লিঙ্গ ঐ স্থানের সৌর্ন্দয্য দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন শ্রীগুরুদেব সুপ্রসন্ন না থাকিলে কত কষ্ট করিয়া এস্থান খুঁজিয়া বাহির করিতে হইত। পথের অশেষ কষ্ট সহ্য করিয়া ও দারুণ দুর্ভাবনার মধ্যে তিনি পথ চলিতেছিলেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে তাঁহার অভীষ্ট যে সিদ্ধ হইয়াছে সেজন্য তিনি বার বার শ্রীগুরুকে স্মরণ ও প্রণাম করিলেন। ত্রিপুর্লিঙ্গ পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত চিত্তে একখ- পাথরের উপর বসিয়া পড়িলেন।
ইতিমধ্যে লামাস্বামী কিছু ফলমূল লইয়া আসেলেন এবং তাঁহাকে বলিলেন, “ঝরণা হইতে হাত মুখ ধুইয়া আইস। তারপর এই ফলমূল খাইয়া সুস্থ হও। পরে তোমার সহিত আলাপ করিব।” ত্রিপুর্লিঙ্গ হাত মুখ ধুইয়া অতি সুমধুর স্বাস্থ ফলমূল খাইয়া খুবই তৃপ্তি লাভ করিলেন। এমন সুস্বাদু ফল জীবনে তিনি কমই খাইয়াছেন। ইহার পর তিনি লামাস্বামীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার সম্মুখে গিয়া বসিলেন। তখন বেলা অবসান প্রায়, ভগবান মরীচিমালী রক্তিমরাগে আকাশ রঞ্জিত করিয়া ধীরে ধীরে কোন্ এক অজানা দেশের উদ্দেশ্যে বিশ্রামের জন্য বিদায় লইতেছেন। একদিকে সূর্য্য অস্তাচলগামী হইতেছেন, অপর দিকে চন্দ্রমা নিজ স্নিগ্ধ শুভ্র কিরণে দশদিক প্লাবিত করিয়া সন্ধ্যাদেবীকে যেন আহবান জানাইতেছেন।
লামাস্বামী কথাপ্রসঙ্গে বহু শাস্ত্রীয় কথার অবতারণা করিয়া বলিলেন, “তুমি কিমিয়া বিদ্যা প্রভৃতি জাগতিক যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞানলাভের সংকল্প মন হইতে দূর কর, এ সমস্তই নশ্বর ও অমূলক, পরমাত্মা পরমপুরুষ শান্ত নিষ্ক্রিয়, নিশ্চল ও নির্ব্বিকল্প, নিরঞ্জন। মনের শুদ্ধসত্ত্ব নিঃসংকল্প অবস্থায় নিরপেক্ষ নিরলম্বভাবে স্থিতি তাহাই আত্মসংস্থ নিশ্চিন্ত পরমাত্মারূপ- ইহা অব্যক্ত অনির্ব্বচনীয় একমাত্র সাধনগম্য। কেহ ভাষাদ্বারা ইহা কাহাকেও বুঝাইতে পারে না তখন পৃথিবীর সব কিছু যেমনটী ছিল তাহাই থাকা সত্ত্বেও মন যেমন ভাবে পূর্ব্বে অনুভব ও উপভোগ করিত তাহা যেন বদলাইয়া যায়। তখন আর পূর্ব্বের আসক্তি ভাবযুক্ত উপলব্ধি থাকে না সব কিছুই শান্তিময় ও আনন্দময় হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ না হইলে পরাশান্তি পাইবে না। কোন কিছুর অপেক্ষা না করিয়া নিরালম্বভাবে মনের যে শান্ত অবস্থা তাহাতে স্থিতি হইলে এবং সর্ব্বাবস্থায়ই একভাবে স্থিতি লাভ করিতে পারিলেই কূটস্থ চৈতন্যে স্থিতি হয়।
“জগতের যাবতীয় বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণকে প্রত্যাহার করিয়া শান্ত ভাবে থাকিতে অভ্যাস করিতে হইলে জগতের যাহা কিছু বস্তু আছে তৎসমস্ত বিষয়েই উপেক্ষা ও ত্যাগ আনিতে হইবে। মূলে উপেক্ষা ও ত্যাগ ঠিক ঠিক রাখার জন্যই ব্যবহারিক বিচিত্রতাময় লীলাক্ষেত্র এই জগতে নিঃসঙ্গভাবে জ্ঞানীগণ কর্ম্ম করিয়া থাকেন, বস্তুতঃ এই জগত স্বপ্নবৎ। নানাপ্রকার বিচিত্রতার মধ্যেই যে ব্যবহারিক সত্ত্বা লইয়া জীবজগত লীলা করিতেছে ইহার অন্তরালেই সেই নিত্য সত্য বুদ্ধ পরমাত্মার স্বরূপ চিরবিরাজমান রহিয়াছেন। এই সত্যকে উপলব্ধি করিয়া নিত্য আনন্দে মগ্ন থাকিয়া এই জগতের অনিত্য লৌকিক আচার ব্যবহারের ভিতর বিচরণ কর, কোন কিছুতেই আর বদ্ধ হইবে না। অনিত্য জ্ঞানে কোন কিছুতেই অভিমানাত্মক কর্ত্তৃত্বাভিমান থাকিবে না- তোমাকে আর কোন বস্তুতেই আবদ্ধ করিতে পারিবে না। বৎস, চরম লক্ষ্যে পৌঁছিবার ইহাই একমাত্র উপায়।”
এইরূপ নানাপ্রকার উপদেশ ও নিয়মিত ব্রহ্মাভ্যাস ও যোগক্রিয়ার কৌশল শিক্ষা করিতে করিতে সেখানে ত্রিপুর্লিঙ্গের প্রায় দেড় বৎসর কাটিয়া গেল। একদিন পাহাড়ের গায়ে এক বৃক্ষমূলে ত্রিপুর্লিঙ্গ বসিয়া আছেন, এক তম্ময়ভাবে তিনি মগ্ন- ক্রমে ক্রমে তাঁহার বাহ্যজ্ঞান লোপ পাইয়া গেল। এইভাবে কতক্ষণ ছিলেন উহা তাঁহার বোধ ছিল না কিন্তু যখন তাঁহার চেতনা ফিরিয়া আসিল তখন তিনি সমস্তই যেন মধুময় বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহার হৃদয়তন্ত্রী কাহার মধুর স্পর্শে যেন এক অতি সুমধুর তানে বাজিয়া উঠিল। তাঁহার মনের সকল রুদ্ধ দুয়ার খুলিয়া গেল- তাঁহার মনে হইতে লাগিল জগতটা যেন কি এক আনন্দে পূর্ণ ও চৈতন্যময়- সে আনন্দের শেষ নাই- সীমা নাই! বৃক্ষলতা, পাহাড়পর্ব্বত, আকাশ, বায়ু, জলস্থল সকলই যেন কি এক আনন্দে পূর্ণ - সে আনন্দের ছটায় চারিদিক উদ্ভাসিত। কি এক অপূর্ব্ব মধুর সুরতান সমন্বিত সঙ্গীত উত্থিত হইয়া অনন্তাভিমুখে কোথায় যেন ভাসিয়া চলিয়াছে। তাহার যেন শেষ নাই। ত্রিপুর্লিঙ্গ আরও অনুভব করিলেন, গ্রহ নক্ষত্র প্রভৃতি অনন্ত জ্যোতিষ্কমণ্ডল কি যেন কি মধুর উজ্জ্বল প্রভায় উদ্ভাসিত হইয়া অমৃত আস্বাদনের জন্য অনন্তের পথে ছুটিয়া চলিয়াছে। তারপর ‘অব্যক্তং অচিন্ত্য অনির্ব্বচনীয়ং’ অবস্থা- এইরূপ স্থির নিশ্চল নিষ্পন্দভাবে বহুক্ষণ অতীত হইয়া গেল।
ত্রিপুর্লিঙ্গ এক অনির্ব্বচনীয় ভাবে বিভোর হইয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে কুটীরে ফিরিয়া আসিলেন। লামাস্বামী ত্রিপুর্লিঙ্গকে দেখিয়া বলিলেন, “বৎস, তোমার বদনম-ল ব্রহ্মানন্দে জ্যোতির্ম্ময় হইয়া উঠিয়াছে- তবে কি তোমার ব্রহ্মজ্ঞান উপলব্ধি হইয়াছে? তুমি কি সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ অবাংমনসো গোচরং পরমাত্মাকে জানিতে পারিয়াছ?” ত্রিপুর্লিঙ্গ সানন্দে স্মিতমুখে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন।
আত্মতত্ত্ব লাভের পর ত্রিপুর্লিঙ্গ আরও কিছুকাল তথায় বাস করিলেন। লামাস্বামীর সঙ্গে তাঁহার দিনগুলি অতি আনন্দেই কাটিতেছিল। কিন্তু এই আনন্দ তাঁহার আর ভোগ করিতে ইচ্ছা হইল না। জীবজগতের জন্য তাঁহার প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল। তিনি মনে মনে ভাবিলেন তিনি যে অমৃত আহরণ করিয়াছেন সকলেই তাহার ফল ভোগ করুক এবং তাপিত জীবজগত আনন্দময় হউক। ত্রিপুর্লিঙ্গের হৃদয়তন্ত্রীতে এক অপূর্ব্ব রাগিণী বাজিয়া উঠিল। তিনি লামাস্বামীর নিকট আপন মনের কথা খুলিয়া বলিলেন। স্বামীজী তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, “বৎস, যে মহাপুরুষ আপনার আন্তরিক শক্তি প্রভাবে শ্রোত্র, নেত্র, নাসিকা প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয়গ্রামকে সম্পূর্ণরূপে সংযত করিয়া ফলাভিসন্ধি বিবর্জ্জিত হৃদয়ে বাক, পানি, পাদ প্রভৃতি কর্ম্মেন্দ্রিয় সহকারে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন সেই বিবেকী মহাত্মাই শ্রেষ্ঠ এবং যিনি ভোগবিলাস সাগরে ভাসমান হইয়াও চিত্তকে কদাচ তাহতে লিপ্ত মা মগ্ন হইতে দেন না, যিনি বাহ্যতঃ বিষয় রাজ্যে বিচরণশীল হইলেও অন্তরে সম্পূর্ণ উদাসীন সেই সাধু ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ। আশীর্ব্বাদ করি তুমি তাপিত জগতকে অমৃতের আনন্দ ধারায় শীতল কর। জগতে শান্তির ধারা বর্ষিত হউক।”